Thursday, July 26, 2012

রোহিঙ্গাদের আমরা ফের বাঘের মুখে ঠেলে দিতে পারি না - এ বি এম মূসা

বিশিষ্ট সাংবাদিক এ বি এম মূসা বলেছেন, আশ্রয় প্রার্থীকে আশ্রয় দেওয়া শুধু মানবিক ও নীতিগত বিষয় নয়, এটি আমাদের ধর্মীয় ও জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ (সা.) মক্কা থেকে হিযরত করে মদিনায় গেলে মদিনাবাসী যদি আশ্রয় না দিতেন তাহলে পৃথিবীতে ইসলাম বলে কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হতো না।


তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা কিন্তু আমাদেরই পূর্ব পুরুষ। বাঘের ভয়ে পালিয়ে আসা এসব মানুষকে আমরা আবার বাঘের মুখে ঠেলে দিতে পারি না। চলমান রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা এবং বাংলাদেশের আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানানোর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এক সাক্ষাৎকারে এ বি এম মূসা এ কথা বলেন। প্রবীণ এই সাংবাদিকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, সরকার বলছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া যাবে না। কারণ, মিয়ানমারে এখন যুদ্ধকালীন অবস্থা নয়, অভ্যন্তরীণ দাঙ্গা চলছে। এই অবস্থাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?



 এ বি এম মূসা : যুদ্ধকালীন অবস্থা হোক কিংবা গৃহযুদ্ধ চলুক, সেটা বড় কথা নয়। কিছু লোক বিপদগ্রস্ত হয়ে আশ্রয় চেয়েছে। মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের আশ্রয় দেওয়া উচিত। শুধু দেখতে হবে, এ কারণে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে কিনা। সব কিছুর ঊধের্্ব হচ্ছে মানবিকতা। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ (সা.) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিযরত করলেন, তখন তাকে যারা আশ্রয় দিলেন তারা সবাই ছিলেন ইহুদি। তা সত্ত্বেও তারা নবী করিম (সা.) এবং তার সাহাবিদের আশ্রয় দিয়েছিলেন।



 বাংলাদেশ প্রতিদিন : আগের দফায় রোহিঙ্গারা এসে অনেক সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে। সেই অভিজ্ঞতার পর কীভাবে তাদের আশ্রয় দেওয়া যায়?



 এ বি এম মূসা : রোহিঙ্গারা আগের বার এসে অনেক সমস্যা সৃষ্টি করলেও এ জন্য শুধু তারা দায়ী নয়। দায়ী হচ্ছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের ব্যর্থতা। নিজেদের অতীতের ব্যর্থতার কারণে এখন অন্যরকম ব্যবহার করব_সেটা হয় না। অতীতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যে সব সমস্যা হয়েছিল, তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। রোহিঙ্গারা এদেশে এসে আমাদের লোকদের সহায়তায় সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এ জন্য যে সব দুষ্কৃতিকারী জড়িত, তাদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।



 বাংলাদেশ প্রতিদিন : সরকারের আশ্রয় না দেওয়ার সিদ্ধান্তকে অনেকে সঠিক বলে মন্তব্য করেছেন। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন।



 এ বি এম মূসা : ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারত আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল। তখন আমাদের যে শরণার্থী শিবিরগুলো ছিল সেগুলো ঘেরাও করে রাখা ছিল, যাতে শরণার্থীরা মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশতে না পারেন। একইভাবে রোহিঙ্গাদেরও ছোট ছোট দ্বীপে রাখার ব্যবস্থা করা যায়। আমাদের অনেক ছোট ছোট নির্জন দ্বীপ রয়েছে। সেখানে তাদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দেওয়া যেতে পারে। তাদের ভরণ পোষণের জন্য প্রচুর পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন। যারা তাদের আশ্রয় দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে, সেসব আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। শ্রীলঙ্কার তামিলদের বছরের পর বছর আশ্রয় দিয়েছে ভারত। ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দিচ্ছে সারা বিশ্ব। ১৯৭১ সালের আগে দাঙ্গার কারণে বিচ্ছিন্নভাবে অনেক বাঙালি পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভেদের কারণে এক দেশ থেকে অন্য দেশে আশ্রয় চায় মানুষ।



 বাংলাদেশ প্রতিদিন : সরকার খাদ্য সহায়তা দিয়ে রোহিঙ্গাদের বিদায় করে দিচ্ছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?



 এ বি এম মূসা : বাঘের ভয়ে পালিয়ে আসা লোককে আমরা আবার বাঘের মুখে ঠেলে দিতে পারি না। এ ব্যাপারে সরকার কূটনৈতিক পর্যায়ে কোনো কথা বলেনি। সরকার জাতিসংঘের কাছে নালিশ জানাতে পারত। ১৯৭১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি সারা বিশ্ব ঘুরে বাংলাদেশের জন্য সাহায্য চেয়েছেন এবং পেয়েছেন। বাংলাদেশে এখন মিয়ানমারের রাষ্ট্রপ্রধানকে অভ্যর্থনা জানাতে তোড়জোড় চলছে। আমাদের রাষ্ট্রদূত কেন এখনো মিয়ানমার যাননি। মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো আলোচনা বৈঠকও করেননি। তাদের দেশের লোকদের নিয়ে এখন যে সমস্যা, তার জন্য মিয়ানমারের সঙ্গেই তো কথা বলতে হবে। রোহিঙ্গারা আমাদেরই পূর্ব পুরুষ। দায়িত্ব পালন না করে তাদের আবার বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি না।

সৈজন্যেঃ- বাংলাদেশ প্রতিদিন ২১-০৬-২০১২

রোহিঙ্গা শরণার্থী ‘দরিয়া কিনারে আজ দুঃখ অথৈ’ -ফারুক ওয়াসিফ


prothom-alo.com/detail/​date/2012-06-16/news/266044

রোহিঙ্গা শরণার্থীদরিয়া কিনারে আজ দুঃখ অথৈ’ -ফারুক ওয়াসিফ | তারিখ: ১৬-০৬-২০১২ দৈনিক প্রথম আলো

দরিয়া কিনারে আজ দুঃখ অথৈ;
করজোড়ে বলি, গ্রহণ করো রহম করো ভাই

ইতিহাসের কী অদ্ভুত পরিহাস! অষ্টম শতকে এক আরব সওদাগরি জাহাজ পশ্চিম আরাকান উপকূলে ভেঙে পড়ে স্থানীয় রাজার নির্দেশ হয়, এদের হত্যা করো অসহায় আরবেরা তখন নিজ ভাষায় রাজার প্রতিরহমকরার আবেদন জানায় তারাই এই এলাকার নাম দেয় রহম-ব্রি, যার অর্থ করুণার ভূমি বর্তমানেও আরাকানে রামব্রি নামের দ্বীপটি আছে, কেবল রহমের কোনো চিহ্ন নেই বলা হয়, এই রহম থেকেই আরাকানিদের আদি নাম রোহানের উৎপত্তি এবং রোহান থেকে রোহিঙ্গা নামের জন্ম সেই রহমের দেশের মানুষ স্বদেশে রহমবঞ্চিত হয়ে আমাদের দেশের জলসীমান্তে এসে উপস্থিত করুণা ভিক্ষা করে তারা বলছে, ‘ভাসা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা আমরা সাতভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে করে এসে ঠেকেছি এই বিপাকেপরিণামে আমাদের কোলে-কাঁখে শিশু, ঘরপোড়া কাঠে কালো কালো যিশু দরিয়া কিনারে আজ দুঃখ অথৈ, করজোড়ে বলি, গ্রহণ করো রহম করো ভাই

রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের চোখে উটকো ঝামেলা আর মিয়ানমারের কাছে বহিরাগতবাঙালি মিয়ানমারে তারা ঘৃণিত, বাংলাদেশে তারা পরিত্যক্ত সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি রোহিঙ্গা আন্দোলনের পেছনে জামায়াতে ইসলামীর উসকানি খুঁজলেও ভাসমান মানুষের চোখের পানি দেখতে পাননি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের শাসকশ্রেণী যে বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক ঘৃণায় কলঙ্কিত করে, আমাদের সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি তা থেকে কতটা ভিন্ন?

মিয়ানমারের সরকার জনগণের বড় অংশ গভীরভাবে বিশ্বাস করে, রোহিঙ্গারা অপরাধপ্রবণ, মৌলবাদী, ঠিক মানুষ নয়, দ্বিপদবিশিষ্ট আপদ তাদের এই বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সেবনে বাংলাদেশের শাসক মহলেরও দেখি আপত্তি নেই ধরনের মনোভাবকেই জাতবিদ্বেষ, বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি বলা হয় মিয়ানমারে আধাসামরিক সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চিও রোহিঙ্গা মুসলমানদের বর্ণবাদীকালারনামে ডাকছেন জন্য তাঁদের বর্ণবাদী বললেঅপমানহবে অপমান, লাঞ্ছনা দুর্দশা তাই রোহিঙ্গাদেরই ললাটলিখন

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্ভাগ্যের অন্যতম একটি কারণ এই মনোভাব এই মনোভাবের ধোঁয়া কেটে গেলে দেখা যাবে, রোহিঙ্গারা আজ সে রকম নিপীড়ন গণহত্যার শিকার, ১৯৭১ সালে যা এক কোটি বাঙালিকে শরণার্থী হতে বাধ্য করেছিল আন্তর্জাতিক আইনে শরণার্থী মর্যাদার পূর্ণ দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় পরিচয় এবং পরাশক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক লীলাখেলায় তারা খরচযোগ্য তাদের মারলে বা আশ্রয় না দিলে কোনো দোষ নেই তাদের জন্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হস্তক্ষেপ কিংবা উদ্বাস্তু তহবিলের টাকার টানাটানি কখনো শেষ হয় না

উগ্র জাতীয়তাবাদী মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী করে দিয়েছে আদমশুমারিতে তাদের গণনা করা হয় না তাদের বাঁচামরা, বিবাহ সন্তানধারণ, কাজ ভ্রমণ, লেখাপড়া বাণিজ্যসবই সামরিক শাসকদের কৃপার অধীন এবারের মতো আরও অজস্রবার তাদের বসতি পুড়েছে, তাদের ওপর জাতিগত শুদ্ধির গণহত্যা চলেছে অথচ শত শত বছর ধরে এরাই আরাকানের আদিবাসী এবং রোহিঙ্গারা ছিল আরাকানের জনসংখ্যার অর্ধেক আরাকান রাজ্য এমনিতেই দুর্গম পাহাড় দিয়ে মূল বার্মা থেকে আলাদা সে কারণে খ্রিষ্টপূর্ব সময় থেকেই বৃহত্তর ভারতবর্ষের সঙ্গেই তাদের যোগাযোগ এই অঞ্চলে ভারতীয় হিন্দু, বৌদ্ধ ইসলামের প্রভাব হাজার বছরের বেশি পুরোনো মধ্যযুগে এই হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা চন্দ্র-রোসাং আর মুসলমানেরা রোহাং নামেই পরিচিত ছিল

প্রাচীন সমৃদ্ধ আরাকানের বিপর্যয়ের শুরু মূলত ১০৪৪-১০৭৭ খ্রিষ্টাব্দে বার্মিজ রাজা আনাওরথার আগ্রাসনের সময় থেকে তিনি হাজার হাজার স্থানীয় রোসাং, রোহাং এবং রেকং বা রাখাইনদের হত্যা করেন; দেশত্যাগী হয় লাখ লাখ আরাকানি

ঐতিহাসিকেরা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, চট্টগ্রামে বসবাসকারী চাকমা, রাখাইন, মারমাসহ অনেক জনগোষ্ঠী সে সময়ই দেশত্যাগী হয়ে বাংলাদেশে বসত করে রাজা আনাওরথাই প্রথম অহিংসার বৌদ্ধ ধর্মকে বর্ণবাদী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন স্থানীয় বৌদ্ধ মতবাদ হটিয়ে তিনি থেরাভাদা বৌদ্ধ মতবাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেন পঞ্চাশের দশকে বার্মার সামরিক সরকারও একে রাজধর্ম করে এবং দেশের ১৮০টির বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ঔপনিবেশিক কায়দায় কোণঠাসা করে রাখে এরই প্রতিক্রিয়ায় রোহিঙ্গারা ছাড়া বাকি আদিবাসীরা অস্ত্র হাতে তুলে নেয় সু চির বাবা অং সানের অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিলেন মুসলমানদের নেতা রাজাক তিনি সে সময় সেক্যুলার জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলমানদের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত করেন শিক্ষা পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে মুসলিম বৌদ্ধ বার্মিজদের কাছে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন সু চির বাবা অং সানের নেতৃত্বে সংবিধানে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিশেষাধিকার অন্তর্ভুক্তির সময় রাজাকের কারণেই মুসলমানরা বাদ পড়ে সু চি হয়তো ভুলে গেছেন, তাঁর বাবার সঙ্গে একত্রে রাজাকও নিহত হন মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জঙ্গি বা বিদ্রোহী হওয়ার রেকর্ড অন্য বার্মিজদের তুলনায় শতগুণ কম অপরাধপ্রবণতার দিক থেকেও তারা পিছিয়ে সুতরাং মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের মন্ত্রী যা বলেছেন, তা ঠিক নয়

পঞ্চাশের দশক থেকে সামরিক সরকার বার্মার জনগণকে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতায় উত্তেজিত করে বিভক্তির শাসন চালিয়ে যাচ্ছে সাম্প্রতিক দাঙ্গার পেছনেও পাওয়া যাচ্ছে এক তরুণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে আফগানিস্তানের তরুণ তালেবান মৌলবাদীদের অনুকরণে তাঁকে বলা হচ্ছেতালেবান সন্ন্যাসী বার্মার সরকারি বিরোধী দলও মুসলমান ভারতীয় বংশোদ্ভূত লোকজনের বিরুদ্ধে এককাট্টা তাই আজ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে জাতিগত গণহত্যা চলছে, অচিরেই সেটা অন্যান্য ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের বিরুদ্ধে যে হবে না, তার নিশ্চয়তা কী?

ঘৃণার রাজনীতি প্রথম হত্যা করে সত্য ইতিহাসকে যে যুবকটি রাখাইন নারী ধর্ষণের অপরাধী, তার বাবা নিজেও একজন রাখাইন রাখাইনের ঘরে জন্ম নিয়ে সে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে চলে আসে বাবার মৃত্যুর পর ছেলেটি ভবঘুরে অপরাধীদের খাতায় নাম লেখায় অন্যদিকে, ধর্ষণের প্রতিহিংসায় যে ১০ জনকে হত্যা করা হয় তারা কেউই রোহিঙ্গা নয়; এমনকি সবাই মুসলমানও নয় অভিযোগ রয়েছে, মিয়ানমারের গণতন্ত্রের যাত্রাকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে দাঙ্গা ঘটানো হয়েছে ধর্ষকদের হাতেও যে যোগাযোগ প্রযুক্তি দেখা গেছে, সেটা সাধারণ ভবঘুরেদের হাতে থাকার কথা নয়

দাঙ্গা শুরু হয় জুন কিন্তু গত এপ্রিল থেকেই বার্মার সরকারি গণমাধ্যম রাজনৈতিক দলগুলো মুসলিমবিরোধী জিগির তুলে যাচ্ছিল কয়েক মাস আগে অং সান সু চির দলের এক এমপি লোক লেলিয়ে দাঙ্গা ঘটান দুই. মানবসমাজ চিরকালই অভিবাসনপ্রবণ ছিল অতীতে যখন রাষ্ট্র সীমান্তের প্রতাপ এত ছিল না, তখন হরহামেশাই এক সমাজের মানুষ অন্য সমাজে গিয়ে বসতি গেড়েছে এবং গৃহীত হয়েছে মিয়ানমারের মগ রাখাইনেরা যেমন বাংলাদেশে বসতি করে, তেমনি অনেক বার্মিজ জাতিগোষ্ঠী কম্বোডিয়া-ভিয়েতনাম প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আজকের মিয়ানমারে এসে থিতু হয়

১৪৩৩ সালে আরাকান বাংলা সালতনাতের অধীন হয় আরাকানের রাজারা একাধিকবার রাজ্য হারিয়ে গৌড়ের মুসলিম সুলতান অথবা মোগল দরবারে আশ্রয় নিয়েছেন এবং তাঁদের বাহিনীর সমর্থনেই হারানো রাজ্য উদ্ধার করেছেন মধ্যযুগ থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত অনেক আরাকানি রাজবংশের নামে মুসলমান পরিচয় পাওয়া যায় এর অর্থ মুসলমানেরা সেখানে সংখ্যা সম্মানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কবি আলাওল, সৈয়দ আশরাফ প্রমুখ আরাকানের রোসাং রাজসভারই মন্ত্রী ছিলেন চট্টগ্রামের মানুষ যেমন আরাকানে গেছে, তেমনি অনেক আরাকানিও বিভিন্ন যুগে বাংলাদেশে বসতি গড়েছে ১৪ শতকের ইতিহাসবিদ রশিদুদ্দীন থেকে শুরু করে, তুর্কি নাবিক সিদি আলী, আইন- আকবরি, বাহরিস্তান গায়েবি, সিয়ারুল মুতাখারিন-এর লেখকেরাও এর প্রমাণ দিচ্ছেন ষোড়শ শতকের ব্রিটিশ পর্যটক ্যালফ ফিচও আরাকানের নাম বলছেন রুয়ং, যা শুনতে রোয়াংয়ের মতো ইতালীয় পর্যটক মানুচ্চি ফারসি সূত্র ধরে একে বলেছেন রেকন চট্টগ্রামের শঙ্খ নদের তীরে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠীর নাম রোওয়াঙ্গি বা রোয়াংয়ের মানুষ ষোড়শ শতকে শায়েস্তা খাঁ চট্টগ্রামকে মগ বা আরাকান দখল থেকে মুক্ত করার আগে প্রায় এক শতাব্দী এলাকাটি আরাকানের অংশ ছিল এই ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক যোগাযোগের কারণেই আরাকান বিষয়ে বাংলাদেশের সজাগ থাকা প্রয়োজন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেওয়ার কারণ সাম্প্রদায়িক মুসলিম বিদ্বেষ হলে তা লজ্জার ব্যাপার মানবিক রাজনৈতিক কারণটিই বড় করে দেখতে হবে

কিন্তু কেন বাংলাদেশ সমস্যাটি ঘাড়ে নেবে? সরকার যে জাতীয় স্বার্থের অজুহাত দিচ্ছে, তা যদি তারা মানতেন, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের বিক্ষুব্ধ করে তুলতেন না যারা স্বদেশবাসীদের নিজ ভূমিতে উদ্বাস্তু করে রাখতে পারে, তারা প্রতিবেশীদের আশ্রয় দেবেএমন আশা বাতুলতা তবে, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত, সমুদ্রসীমাসহ বহুবিধ সমস্যা রয়েছে সেসব সমস্যা সমাধানের চাপ হিসেবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া কৌশলগত চাল হিসেবে খারাপ হয় না অন্যদিকে, দীর্ঘ মেয়াদে আরাকান অঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ভূমিকা রাখতে পারে আরাকান চট্টগ্রামের আরও কাছাকাছি আসা উভয়ের স্বার্থেই দরকার আরাকানে যত দিন অশান্তি থাকবে, তত দিন আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে অস্থিতিশীলতার ঢেউ আছড়ে পড়বে

এবারে যেহেতু রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক মনোযোগে এসেছে, একাত্তরের ভারতের মতো শরণার্থী সমস্যা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ আরাকানে শান্তি কায়েমে ভূমিকা রাখতে পারে মিয়ানমারে নির্বাচনী গণতন্ত্র কায়েম হলে পূর্বাঞ্চলীয় আসাম-ত্রিপুরার মতো এই অঞ্চলটিও হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মিত্র ব্যবসায়িক অংশীদার বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের বিষয়ে একেবারে কঠোর হলে তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা দেশে আশ্রয় পেত না কিন্তু এই দায় একা বাংলাদেশের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয় জাতিসংঘ, আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে কেবল বাণী ঝাড়লে হবে না, মিয়ানমারের ওপর চাপ দিতে হবে, বাংলাদেশকে তহবিল রাজনৈতিক সমর্থন জোগাতে হবে তার জন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে দীর্ঘদিনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক হারাতে হতে পারে ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত অস্ট্রেলিয়াকে আমাদের সরকারের উচিত, বলটা আন্তর্জাতিক মুরব্বিদের মাঠে ঠেলে দেওয়া এবংবলা, আমরা গ্রহণে প্রস্তুত, কিন্তু তোমাদেরই আগে সদিচ্ছার প্রমাণরাখতে হবে বাংলাদেশে আগমনকারী লাখ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনের স্বার্থেও বিষয়টির একটা আখেরি সুরাহা হওয়া দরকার কয়েক হাজার শরণার্থীকে ফিরিয়ে এই সমস্যা এড়ানো যাবে না, মানুষ আসাও ঠেকানো যাবে না

অবশ্যই আমাদের রাষ্ট্রবুদ্ধি প্রয়োজন, কিন্তু তার জন্য অমানবিক হতে হবে কেন?

 ফারুক ওয়াসিফ: লেখক সাংবাদিক              farukwasif@yahoo.com