Friday, April 13, 2012

ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল’ অব দ্য সি (ইটলজ)-এর রায়ে বাংলাদেশ হারিয়েছে বেশি : তেল-গ্যাসের ৬টি ব্লক পুরোপুরি ও ৪টি আংশিক হাতছাড়া

দৈনিক আমারদেশ-এর সৈজন্যে


মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মামলার রায়ে বাংলাদেশ হারিয়েছে বেশি। সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়া ছাড়া সবক্ষেত্রেই হেরেছে দেশটি। মিয়ানমারের সব দাবিকেই প্রাধান্য দিয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত। এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের একটি বড় অংশ হারিয়েছে বাংলাদেশ। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নির্মিত ছয়টি ব্লক পুরোপুরি হাতছাড়া হয়ে গেছে। আরও চারটি ব্লকের আংশিক পেয়ে গেছে মিয়ানমার। এতে সমুদ্রে সম্ভাব্য তেল-গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশ হারাল বাংলাদেশ। 


২০০ নটিক্যাল মাইল সমুদ্রসীমা প্রাপ্তির মাঝেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। সেন্টমার্টিন ইউনিয়নকে দেশটির ভূখণ্ডের মূল সীমানার বাইরে ধরেই সমুদ্রসীমার হিসাব করা হয়েছে। টেকনাফকে সর্বশেষ সীমানা ধরে ২০০ নটিক্যাল মাইল সমুদ্রসীমা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশকে। 

ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল’ অব দ্য সি (ইটলজ)-এর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির রায় পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। নদী, সমুদ্র ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা এ রায় পর্যালোচনায় বাংলাদেশের বিশাল হারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।


তাদের মতে, বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমা নিয়ে বেশিরভাগ বিষয়ে বাংলাদেশের নীতিগত ও অধিকারগত হার হয়েছে। অর্জন কেবল বিরোধ নিষ্পত্তি ও সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়া। ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গ কি.মি. সমুদ্রসীমা প্রাপ্তির গল্পও সঠিক নয়। ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পরই এ পরিমাণ সমুদ্র বাংলাদেশের অধিকারে আসবে।




রায়ের ৪৯ ও ৫০ অনুচ্ছেদে দেখা যায়, উভয় দেশের যুক্তি শুনে আদালত প্রথমে মহীসোপানের ২০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়।

এক্ষেত্রে মিয়ানমারের দাবি অনুযায়ী সেন্টমার্টিন দ্বীপকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ধরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হয়। রায়ের ৩৩৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ সীমানা সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ থেকে সরিয়ে এনে টেকনাফ ধরা হয়। আর সে অনুযায়ী টেকনাফকে দক্ষিণ সীমানা ধরে বাংলাদেশকে উত্তর ও পূর্ব প্রান্তে সমদূরত্ব রেখা এবং দক্ষিণ ও পশ্চিমদিকে সর্বাধিক ১২ নটিক্যাল মাইল টেরিটরিয়াল সমুদ্রের মালিকানা দেয়া হয়।



সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করে মিয়ানমারের সঙ্গে ১৯৭৪ ও ২০০৮ সালে সমঝোতা চুক্তি আছে বলে বাংলাদেশ পক্ষের কৌঁসুলিরা যুক্তি তুলে ধরলেও আদালতে তা পাত্তা পায়নি। বরং পাল্টা যুক্তিকে গ্রহণ করে আদালত মিয়ানমারের পক্ষে রায় দেয়।

পলিপাতন বিভাজন রেখার যুক্তিতে বাংলাদেশের মহীসোপানের দাবিটিও গ্রহণ করেনি আদালত। সমুদ্রসীমা আইনের ৫ ও ৬ নং উপধারা অনুযায়ী ‘মহীসোপানের সীমা ২৫০০ মিটার গভীরতা থেকে ১০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি হতে পারবে না। আবার মহীসোপানের সীমা তটরেখা থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত হতে পারবে; তবে পার্শ্ববর্তী দু’দেশের পলিপাতন বিভাজন রেখার খাঁড়ি অতিক্রম করবে না।’ এ যুক্তি তুলে ধরে বাংলাদেশ মহীসোপানের দাবি করলে মিয়ানমারের বিরোধিতায় আদালত তা গ্রহণ করেনি।


এতে বাংলাদেশ সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম বরাবর তার এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন এলাকা হারিয়েছে।





সমদূরত্ব নীতিতে ন্যায়সঙ্গত সমাধান সম্ভব নয় : আমি কৌণিক দ্বিখণ্ডক পদ্ধতির পক্ষে   -আন্থনি অমোস লাক, বিচারক, আন্তর্জাতিক সমূদ্র আইন আদালত (ইটলস)।

ট্রাইবুনালের সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ের খসড়া মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করে আমার পক্ষে এর সবগুলো বিষয় মেনে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এতে আমি রায়ের মূল কার্যকরী অনুচ্ছেদের ব্যাপারে নেতিবাচক ভোট দেয়ার প্রয়োজন মনে করছি। প্রক্রিয়াগত ইতিহাস এবং তথ্যভিত্তিক পটভূমি রায়ের সূচনাতে বর্ণিত হওয়ায় আমি আর তার পুনরাবৃত্তি করব না। 

সঠিকভাবেই মামলাটিকে অধিকতর জটিল ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং আমাদের বিবেচনার জন্য অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে যেসব প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতেই তা স্পষ্ট হয়েছে। আমিও আইনের প্রযোজ্য ধারা এবং মূল নিয়ন্ত্রক ও গ্রহণযোগ্য প্রমাণ দৃঢ়ভাবে ব্যবহার করেছি। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রমাণসংক্রান্ত আমার মূল্যায়ন সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে ভিন্ন হয়েছে।

এ রকম একটি রায়ে এক বা একাধিক বিষয়ে ভিন্নমত থাকায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। এতে অস্বস্তিরও কিছু নেই। আমার মতে, আমি যে ভিন্নমত দিয়েছি, তা এই বিশেষায়িত আদালতের ব্যবহারশাস্ত্রের উন্নয়ন করে আন্তর্জাতিক সর্বোচ্চ মাত্রার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে কাজে লাগবে। রায়ের, বিশেষ করে ৯৮, ১১৫, ১৮, ১২৫, ৪৯০ এবং ৪৭৫ অনুচ্ছেদ বিষয়ে আমি নিম্নবর্ণিত কারণে দ্বিমত পোষণ করছি।

রায়ের ৮০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অনুমোদিত মাইনুটসের (পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা) আইনগত ভিত্তি নেই—আমি এর সঙ্গে একমত নই। ১১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এফিডেভিটে বাধ্যকারী কোনো প্রমাণ নেই—আমি এর সঙ্গেও ভিন্নমত পোষণ করছি। আমার কাছে মনে হয়নি, মৌখিক সম্মতির অস্তিত্ব সঠিকভাবে প্রমাণ করতে বাংলাদেশ কোনো ঘাটতি রেখেছিল (অনুচ্ছেদ ১১৮)। সমদূরত্ব দ্বারা বিচ্ছিন্ন করার (ইক্যুইডিসট্যান্স) নীতির ভিত্তিতে ন্যায়সঙ্গত সমাধান সম্ভব নয়। এই মামলায় আমি কৌণিক দ্বিখণ্ডক (অ্যাঙ্গেল বাইস্টের) পদ্ধতির পক্ষে। আমি উপকূলরেখার পরিমাপের ব্যাপারে একমত নই (অনুচ্ছেদ ২০৬)। সীমানা নির্ধারণের জন্য মিয়ানমারের উপকূল হওয়া উচিত ভিফ অন্তরীপ পর্যন্ত। আমি বলেছিলাম, রায়ে ২১৫ ডিগ্রি দিগ্বলয় পর্যন্ত রেখা পৌঁছেছে। তা সত্ত্বেও ন্যায়সঙ্গত সমাধানের জন্য সাময়িকভাবে সমদূরত্ব রেখা নির্ধারণের পদ্ধতির সঙ্গে আমি একমত নই।

উপস্থাপতি বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে রায়ে যা বলা হয়েছে, আমার অবস্থান তা থেকে অনেক ভিন্ন। কনভেনশনের ৭৬ নম্বর অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা এবং মহীসোপাানের সীমার ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারের যে কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে আমি একমত নই। রায়ে ‘প্রাকৃতিক প্রসারে’র (ন্যাচারাল প্রলংগেশন) যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এবং এ ব্যাপারে ৭৬ অনুচ্ছেদের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, আমি তার সঙ্গেও একমত নই। আমার মতে, ‘ধূসর এলাকা (গ্রে এরিয়া)’ নিয়ে যে উপসংহার টানা হয়েছে, তা পুরোপুরি সন্তোষজনক নয়। আমার উপসংহার অন্য রকমের।

পটভূমি : বাংলাদেশ ও মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরের সীমান্তবর্তী দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র। সাগরের সম্পদরাজি নিয়ে উভয় দেশেরই গভীর আগ্রহ রয়েছে। এসব সম্পদের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের মজুত। সমুদ্রসীমা নির্ধারিত না থাকায় কোনো দেশই এই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি। এর কারণ বাংলাদেশ মিয়ানমারের তেলখনি সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানে তেল অনুসন্ধানের জন্য চুক্তিতে পৌঁছতে চেষ্টা করে আসছিল। নাফ নদীও এর অন্তর্ভুক্ত।

বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমার ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছানের জন্য দুটি দেশই নিবিড় আলোচনা চালিয়েছে। ১৯৭৪ সালে দেশদুটি যেসব সিদ্ধান্ত নেয় তা-ও লিপিবদ্ধ আছে। ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বরর বৈঠকের সিদ্ধান্ত মাইনুটসে (পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা) লেখা আছে। ওই মাইনুটসে উভয় দেশের প্রতিনিধি স্বাক্ষর করেন।

বাংলাদেশ অভিযোগ করছে, ৩৪ বছর ধরে অনুমোদিত মাইনুট উভয় দেশই মেনে চলেছে। এতে এটি কার্যত একটি চুক্তিতে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমার জানিয়েছে, এ রকম কোনো চুক্তি নেই। কারণ অনুমোদিত মাইনুটগুলো তাদের সরকারের অনুমোদনের এবং উভয় দেশের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক চুক্তির প্রয়োজন ছিল।

এরপর উভয় পক্ষ এ নিয়ে আলোচনা করলেও তা সফলতার মুখ দেখেনি। এর ফলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। ২০১০ সালের ৪ নভেম্বর এক ঘোষণার মাধ্যমে মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ট্রাইবুনালের এখতিয়ার মেনে নেয়। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশও ২০০৯ সালের ১২ ডিসেম্বর এক ঘোষণার মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের এ সংক্রান্ত এখতিয়ার মেনে নেয়।

বিরোধ : মামলার আরজি, প্রমাণ এবং বিজ্ঞ পরামর্শকদের বক্তব্য থেকে দেখা যাচ্ছে, এই জটিল বিষয় নিয়ে দেশদুটোর মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা, একান্ত অর্থনৈনিতক এলাকা (ইইজেড) এবং মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া কনভেনশনের ১৫, ৭৪, ৭৬, ৮৩ এবং ১২১নং ধারার ব্যাখ্যা, নির্মাণ ও ব্যবহার নিয়েও বিরোধ রয়েছে। তবে দুটি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক তথ্য নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। বাংলাদেশের উপকূল বদ্বীপের মতো। আমার মতে, বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য ভূতাত্ত্বিক উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যেমন দুটো দেশের মধ্যে নিজ নিজ সীমানা নির্ধারণে ডকট্রিন অব নেসেসিটি (প্রয়োজনীয়তার মতবাদ) কাজ করতে পারে।


সমদূরত্ব পদ্ধতিতে সীমা নির্ধারিত হলে আবদ্ধ হয়ে পড়বে বাংলাদেশ
-আন্থনি অমোস লাক, বিচারক, আন্তর্জাতিক সমূদ্র আইন আদালত (ইটলস)। 

 মিয়ানমার দাবি করছে, এ সংক্রান্ত মামলার জন্য (জেনেভা) কনভেনশন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইন উপযোগী নয়। কনভেশনের পূর্ববর্তী সময়ে যে নিয়মকানুন প্রচলিত ছিল, তার আলোকে কনভেনশনের বিধানগুলো ব্যাখ্যা করতে হবে। শুধু ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সীমানা নির্ধারণ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারভুক্ত। ট্রাইব্যুনাল ২০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণ করতে পারে কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মিয়ানমার।

বাংলাদেশ যুক্তি দেখিয়েছে, মহীসোপান শব্দটিকে যেন ব্যাপক, উদার এবং ভূতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ— সবদিক থেকে বিবেচনা করা হয়। মিয়ানমার চেয়েছে মহীসোপান শব্দটিকে শুধু ৭৬ অনুচ্ছেদের আলোকে বিবেচনা করতে। মিয়ানমার দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছে, ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে বাংলাদেশের কোনো মহীসোপান নেই। সীমানা নির্ধারণে বাংলাদেশ কৌণিক বিভাজক/দ্বিখণ্ডক (অ্যাঙ্গল বাইসেক্টর) পদ্ধতির পক্ষে এবং মনে করে যে, এর মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত সমাধান সম্ভব। মিয়ানমারের দাবি হচ্ছে, সমদূরত্বের ভিত্তিতে এর সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশ মনে করে, সমদূরত্ব ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণ করা হলে তাতে বাংলাদেশ ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে তার সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না। বাংলাদেশ মনে করে, তার অসুবিধাজনক উপকূলীয় ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সমদূরত্ব রেখার দ্বারা দেশটি আবদ্ধ হয়ে (সেলফ লকড) পড়বে। বাংলাদেশ বলছে, ন্যায়সঙ্গত সমাধান করার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ যুক্তি দেখিয়েছে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ শুক্তি (অয়স্টার) দ্বীপের মতো কোনো দ্বীপ নয়। শুক্তি দ্বীপে কোনো জনবসতি নেই। নেই কোনো বিশুদ্ধ পানি ও অর্থনৈতিক জীবন। অন্যকথায় বাংলাদেশের মতে, ১২১ ধারা অনুসারে শুক্তি দ্বীপ আদতে কোনো দ্বীপ নয়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ একটি ‘বিশেষ পরিস্থিতি’।

আমার মনে হয়, দ্বীপগুলোর ভৌগোলিক অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ সার্পেন্ট দ্বীপের মতো কোনো দ্বীপ নয়। আমার কাছে মনে হয়েছে, দ্বীপগুলোরও উপকূলবর্তী অঞ্চল থাকতে পারে তবে এগুলো পরিপূর্ণ অঞ্চল নয়। (যেমন নর্থ সি কন্টিনেন্টাল সেলফ মামলা (তিউনিশিয়া বনাম লিবিয়া), গিনি ও গিনি বিসাউয়ের মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ এবং কৃষ্ণসাগরের উপকূলীয় সীমানা নির্ধারণ (রোমানিয়া বনাম ইউক্রেন)।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অবস্থান জটিল। এটা কি বিশেষ পরিস্থিতি? এটা কি মিয়ানমার উপকূলের কাছে কিংবা বিপরীতে অবস্থিত? এই দ্বীপটি কি ১২ নটিক্যাল মাইলের সমুদ্রের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে? সেন্ট মার্টিনের জন্য কৌণিক দ্বিখণ্ডক পদ্ধতিতে সীমানা নির্ধারণ উপযুক্ত। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ কোনো বিশেষ অবস্থা বা পরিস্থিতি নয়। এক্ষেত্রে এফিডেভিটে প্রদত্ত সাক্ষ্য বিবেচ্য। দু’দেশের মহীসোপানের সংজ্ঞা নির্ধারণে বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদনও প্রাসঙ্গিক এবং অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।

উপসংহারে পৌঁছানোর জন্য আমি নিম্নোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব : ১. ১৯৭৪ এবং ২০০৮ সালে অনুমোদিত মাইনুট (পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা); ২. ভৌগোলিক পরিস্থিতি; ৩. সীমানারেখা নির্মাণ; ৪. সেন্ট মার্টিন দ্বীপের তাত্পর্য; ৫. কনভেনশনের ৭৬ ধারার ব্যাখ্যা এবং ৬. এ ট্রাইব্যুনাল এখতিয়ারের বাইরে যাচ্ছে কি-না।

আমার মতে, ট্রাইব্যুনালকে প্রতিবেদনের বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদি বিবেচনায় নিতে হবে এবং মিয়ানমার যেসব বিষয় চ্যালেঞ্জ করেনি, তাকেও বিবেচনায় নিতে হবে। বঙ্গোপসাগরের মহীসোপান নিয়ে উপসংহারে পৌঁছানোর জন্য আমি তা-ই করেছি এবং প্রয়োজনে প্রমাণকে প্রয়োগ করেছি।

১৯৭৪ সালে অনুমোদিত মাইনুট : সমুদ্রসীমা নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে কোনো চুক্তি রয়েছে কি-না, তা নিয়ে তারা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ বলছে, উভয় দেশের মধ্যে অনুমোদিত মাইনুট কার্যকর রয়েছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে ১৯৭৪ সালে দেশ দুটির মধ্যে আলোচনা হয়। এতে ৭ দফার ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে উভয় দেশের প্রতিনিধিদের প্রধানরা তাতে স্বাক্ষর করেন। ২০০৮ সালে আাাবার এর সংশোধন করা হয়। এতে আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মহীসোপান নিয়ে উভয় দেশ একটি ব্যাপকভিত্তিক চুক্তিতে পৌঁছানের জন্য আলোচনা অব্যাহত রাখবে।

জবাবে মিয়ানমার বলেছে, অনুমোদিত মাইনুট কোনো চূড়ান্ত চুক্তি নয় এবং ব্যাপকভিত্তিক সমুদ্র চুক্তির জন্য উপসংহারে পৌঁছানোর প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশ বলেছে, এসব কথা মাইনুটে ছিল না এবং অনুমোদিত মাইনুট গত ৩৪ বছর ধরে বহাল ছিল। এসব মাইনুট নিয়ে পরে আর আলোচনার কথা ছিল না।

প্রশ্ন হচ্ছে, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে ১৯৭৪ সালের চুক্তির যে অকাট্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, তা চূড়ান্ত কি-না। আমার মতে, উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ সূচক। প্রথমত মাইনুটের শব্দগুলো স্পষ্ট এবং তা দ্ব্যর্থবোধক নয়। এর সাধারণ অর্থ হচ্ছে, একটি সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে দেখা যাচ্ছে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও মিয়ানমারের উপকূলের মধ্যে একটি সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে।

আগামীকাল পড়ুন : চৌত্রিশ বছর ধরেই বহাল ছিল চুয়াত্তর সালের চুক্তি, ২০০৮ সাল থেকে বেঁকে বসে মিয়ানমার


http://www.amardeshonline.com/pages/details/2012/04/02/139105
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2012/04/12/140621
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2012/04/13/140776