Sunday, May 12, 2013

হেফাজতের প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বৈত আচরণ : সাভারে উদ্ধারকাজে সহযোদ্ধারা মতিঝিলে গণহত্যার শিকার -এরশাদুল বারী


 সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে উদ্ধার তত্পরতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হেফাজত কর্মীরা। রক্তদান, চিকিত্সা সেবা ও হতাহতদের স্বজনদের খাবার সরবরাহেও তত্পর দেখা গেছে হেফাজত কর্মীদের।
 

 ২৪ এপ্রিলের ভবন ধসের ঘটনার মাত্র ১২ দিনের মাথায় মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই নিরীহ হেফাজত কর্মীদের ওপর গণহত্যা চালায়।
 

১২ দিন আগেও হেফাজত কর্মীরা নিজেদের শরীরের তাজা রক্ত দিয়ে, মৃত্যুকূপে জীবন বাজি রেখে দিন-রাত ঘাম ঝরিয়ে মানবতার সেবায় কঠোর পরিশ্রম করেছে। তাদের রক্ত পেয়েই অনেক পোশাক শ্রমিক নিশ্চিত মৃত্যু থেকে ফিরে পেয়েছে নতুন জীবন।
 

 ধ্বংসস্তূপের ভেতরে যখন সরকারের প্রশিক্ষিত সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রবেশ না করে ভবনের সামনে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় ব্যস্ত থেকেছে। তখন আরও অনেক বেসরকারি সংগঠন ও ব্যক্তিগত উদ্ধার কর্মীদের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের এসব কর্মীরা জীবনের মায়া ছেড়ে উদ্ধার কাজে অংশ নিয়ে প্রবেশ করেছে মৃত্যুকূপে। বের করে এনেছে একের পর এক জীবিত মানুষকে। সরকারের উদ্ধার তত্পরতায় হেফাজত ইসলামের কর্মীদের ভূমিকা তখন মিডিয়ায়ও আলোচিত হয়েছে। কিন্তু অল্পদিনের ব্যবধানে হেফাজত কর্মীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছে দেশের মানুষ।
 

 ঘুমন্ত ও ইবাদতরত নিরীহ মানুষদের বুকে গুলি ছুড়ে গণহত্যা চালিয়েছে সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাংশের সদস্যরাই।
 

 আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই দ্বৈত আচরণ দেখে বিবেকসম্পন্ন প্রতিটি মানুষের মনেই প্রশ্নের উদ্রেগ হয়েছে, এরা কি মানুষ? এদের কি কোনো বিবেক, দয়ামায়া নেই? শুধু ক্ষমতালোভী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশের কারণে এভাবে কি একজন মানুষ আরেকজন নিরীহ মানুষের বুকে গুলি চালাতে পারে? পিচঢালা রাস্তায় পরে থাকা গুলিবিদ্ধ নিথর দেহের ওপর লাটিপেটা ও বুট দিয়ে লাথি মারতে পারে?
 

২৫ এপ্রিল রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের পাশে যেতেই চোখে পড়ে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ প্রশিক্ষিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। রানা প্লাজার পাশের ভবন আরএস টাওয়ারে প্রবেশ করতেই দেখা যায়, ওই ভবনের নিচতলা দিয়ে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের সুড়ঙ্গ দিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন দাঁড়ি-টুপি ও পাঞ্জাবি পড়া এক সাধারণ মানুষ। তার পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানান, তিনি সাভারের একটি জামে মসজিদের ইমাম। ভবন ধসের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটে এসেছেন ঘটনাস্থলে। ২৪ এপ্রিল সারাদিন, পরের রাত এবং ২৫ এপ্রিল দুপুর তখন ১২টা সে পর্যন্ত তিনি একটানা ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত মানুষদের উদ্ধারে কাজ করেছেন। পরে জানা গেল তিনি হেফাজতে ইসলামের ওই এলাকার নেতা।
 

 শুধুই ওই ইমামই নয়, একইভাবে অনেক দাঁড়ি-টুপি ও পাঞ্জাবি পড়া মানুষদের দেখা গেল তারা উদ্ধার অভিযানে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করছেন। জীবন বাজি রেখে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া ওইসব মানুষদের সঙ্গে কথা বলতেই তারা জানান, প্রথমদিন থেকেই ভবনের ভেতরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ প্রবেশ করছে না। তারা বাইরে থেকে সহযোগিতা করছেন আর সাধারণ মানুষরা ধ্বংসস্তূপের ভেতরে প্রবেশ করে জীবিত মানুষদের বের করে আনছেন এবং ভেতরে আটকা পড়াদের খাদ্য ও পানি সরবরাহ করছেন। এভাবেই রানা প্লাজার ধসের প্রথম দিন থেকে সাধারণ মানুষ আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একাকার হয়ে একসঙ্গে কাজ করছেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা।
 

মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনায় আহতদের পাশে রক্ত, নগদ অর্থ, চিকিত্সা সেবা, নিখোঁজ স্বজনদের খাবার সরবরাহ করেও সহায়তা করেছে হেফাজতে ইসলামের আলেম-ওলামারা। বিপদের সময় মানবিক দায়িত্ব হিসেবে আহতদের সুচিকিত্সার জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত দিতে সাভারসহ বিভিন্ন মেডিকেল সেন্টারের রক্তদান কেন্দ্রে দ্রুত ছুটে যান বিভিন্ন মাদরাসার হাজার হাজার ছাত্র। দুর্ঘটনাস্থল ও বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। হেফাজতে ইসলাম কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর নেতারা। প্রয়োজনে লাখো ব্যাগ রক্ত দিতে তাদের নেতাকর্মীরা প্রস্তুত বলে ঘোষণা দেন তারা। নিহতদের মাগফিরাত এবং আহতদের সুস্থতা কামনায় বিভিন্ন স্থানে দোয়া অনুষ্ঠান করে সংগঠনটি।

 

 ভবন ধসের খবর শোনার পরপরই বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে পদক্ষেপ নেন হেফাজতে ইসলাম নেতারা। বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা বিপদে পড়ায় সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিয়ে রাজধানীর সব মাদরাসা ছাত্রদের রক্ত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। সে অনুযায়ী হেফাজতে ইসলামের উদ্যোগে সাভার, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার নেতাকর্মী রক্তদান কর্মসূচিতে অংশ নেন। সাভার এনাম মেডিকেলে হাফেজ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে সহস্রাধিক নেতাকর্মী সারিবদ্ধভাবে রক্তদান কর্মসূচিতে অংশ নেন। তাছাড়া মাওলানা মাহফুজুল হকের নেতৃত্বে ঢাকা মেডিকেলে, মাওলানা আবদুর রব ইউসুফীর নেতৃত্বে পঙ্গু হাসপাতালে, মাওলানা যোবায়ের আহমদের নেতৃত্বে আগারগাঁও সন্ধানী হাসপাতালে শত শত নেতাকর্মী আহতদের চিকিত্সার জন্য রক্তদান করেন। সেইসঙ্গে তাত্ক্ষণিকভাবে আয়োজিত বিভিন্ন রক্ত সংগ্রহ ক্যাম্পে গিয়েও হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী এবং রাজধানীর অন্তত ৩০টি মাদরাসার ছাত্ররা এই মহান কাজে অংশগ্রহণ করেন।

 

 হেফাজতে ইসলামের সাভার শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক মুফতি আমিনুল ইসলাম জানান, তিনি ও হেফাজতের প্রায় সাড়ে তিন শতাধিক নেতাকর্মী সাভারের ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপের উদ্ধার অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে অংশ নেয়। সাভারের বিভিন্ন মসজিদের ইমাম ও মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরাও এতে অংশগ্রহণ করেন।

 

 এছাড়া ওই দুর্ঘটনায় নিহতদের মাগফিরাত কামনা ও আহত ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা, মক্তবে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয় সংগঠনটির পক্ষ থেকে। পরে রানা প্লাজায় মর্মান্তিক ঘটনার স্থল পরিদর্শন করেন হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগর আহ্বায়ক মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ, মহানগর সদস্য সচিব মাওলানা জুনাইদ আল হাবীব, যুগ্ম আহ্বায়ক মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনীসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি প্রতিনিধিদল।

 

 ২৫ এপ্রিল বেলা ১২টায় হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগরীর পক্ষ থেকে সাভার দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার ও মারাত্মক আহতদের সুচিকিত্সা নিশ্চিত করার জন্য মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী, মাওলানা মাহফুজুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল নগদ আর্থিক অনুদান নিয়ে সাভার যায়। সেখানে তারা এনাম মেডিকেলে চিকিত্সাধীন রোগীদের খোঁজখবর নেন ও সরাসরি তাদের হাতে নগদ অর্থ তুলে দেন। এ সময় শত শত হেফাজত কর্মী স্বেচ্ছায় রক্তদানের জন্য এনাম মেডিকেলে সারিবদ্ধভাবে হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।

 

 পরে এক সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, সাভারের ভবন ধসের ঘটনায় আহতদের সেবায় হেফাজত কর্মীদের স্বেচ্ছায় দেয়া এক হাজার ব্যাগ রক্ত এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে দেয়া হয়েছে। এছাড়া চিকিত্সার জন্য নগদ টাকা এবং হেফাজতের প্রায় তিন শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধারকর্মীর হিসেবে ঘটনাস্থলে দিনরাত কাজ করেছেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, ২৪ এপ্রিল থেকে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে দ্বিতীয় পর্যায়ের উদ্ধার অভিযান শুরুর আগ পর্যন্ত প্রতিদিনই হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা জীবন বাজি রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে উদ্ধার অভিযানে কাজ করেছেন। সাভারে রাস্তার দুপাশে মহাসড়কে গাড়ি চলাচলে সহায়তা ও রাস্তার পাশে মঞ্চ করে ওষুধ, ঠাণ্ডা পানি ও শরবত বিতরণ করতে দেখা গেছে হেফাজত কর্মীদের।
 

 ঢাকা থেকে সাভার যেতে সাভার বাসস্ট্যান্ডের আগের স্ট্যান্ডের নাম থানা রোড। সেখানে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। তার আগের স্ট্যান্ড হলো গেন্ডা।
 
২৫ এপ্রিল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, গার্মেন্ট কর্মীদের বাঁচাতে এবং তাদের রক্ত ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে গেন্ডা বাসস্ট্যান্ডে ক্যাম্প স্থাপন করেছে হেফাজতে ইসলাম। বিভিন্ন মাদরাসা থেকে কয়েক হাজার ছাত্র সেখানে স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে উপস্থিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতারাও সেখানে উপস্থিতি ছিলেন। এছাড়া ঘটনাস্থলের কাছেই অবস্থিত সাভার ব্যাংক কলোনি মাদরাসা। উদ্ধার কার্যক্রম শুরু হওয়ার পরপরই সেখানকার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুল্লার উদ্যোগে তার মাদরাসার অসংখ্য ছাত্র রক্ত দিচ্ছে।
 

 এভাবেই সাভারে সাধারণ মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছেন হেফাজতের কর্মীরা।
 
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও হেফাজত কর্মীদের সহায়তার হাতকে আরও প্রসারিত করেছে।
 
কিন্তু তার ঠিক ১০ দিন পর ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি শেষে রাজধানীর মতিঝিলে সমাবেশ ও রাতের অবস্থান কর্মসূচিতে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র দেখা গেছে। সেদিন প্রায় অর্ধকোটি মানুষের সমাবেশ ঘটে রাজধানীতে।
 
বিকালে সমাবেশ শেষে হেফাজত কর্মীরা রাতে মতিঝিলে অবস্থান নিলে সরকারের নির্দেশে সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একটি অংশের সদস্যরা গভীর রাতে মতিঝিলে অবস্থান নেয়া ঘুমন্ত ও ইবাদতরত হেফাজত কর্মীদের ওপর শুরু করে স্মরণকালের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। রাত আড়াইটা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত টানা এক ঘণ্টা র্যাব, বিজিবি ও পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় দশ সহস্রাধিক সদস্য মুহুর্মুহু গুলি, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ, রাবার বুলেট, গ্যাস গ্রেনেড বিস্ফোরণ, বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্রসহ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নির্বিচারে হামলা চালায় হেফাজত কর্মীদের ওপর।
 
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বুলেটের আঘাতে শত শত হেফাজত কর্মীর বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায়। বুক, মাথা ও হাত-পাসহ শরীরে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন তারা।
 
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মিলেমিশে সাভারের মানবতার সেবায় অংশ নেয়া এসব হেফাজত কর্মীর বুকে গুলি ছুড়ে গণহত্যা চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা, যে গণহত্যা হার মানায় ২৫ মার্চের কালো রাতকেও। আবারও নিরীহ হেফাজত কর্মীদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে পিচঢালা রাজপথ।