Thursday, December 2, 2010

নতুন ধারার বিশ্ব ইজতেমার দাওয়াত

http://www.samakal.com.bd/details.php?news=72&action=main&menu_type&option=single&news_id=112878&pub_no=531&type

নতুন ধারার বিশ্ব ইজতেমার দাওয়াত
আখেরি মোনাজাতে প্রচুর লোকের অংশগ্রহণ ইজতেমার উদ্দেশ্য নয়, বরং যাতে বেশি বেশি জামাত বের হয় এই নির্দেশনা এখানে প্রদান করা হয়
 
মুফতি এনায়েতুল্লাহ
গত মঙ্গলবার মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হলো বিশ্ব ইজতেমা-পূর্ব তবলিগ জামাতের চিল্লার সঙ্গীদের নিয়ে পাঁচদিনব্যাপী জোড়। দুপুর সোয়া ১২টায় তবলিগের মুরবি্ব মাওলানা মোহাম্মদ ইবরাহিম জোড়ে আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন। লক্ষাধিক চিল্লার সঙ্গী এতে অংশ নেন।

এই জোড়ে শুধু চিল্লার সঙ্গীরাই অংশ নিয়ে থাকেন। আয়োজকরা জানান, ১০-১২টি দেশ থেকে তবলিগ জামাতের পাঁচ শতাধিক প্রতিনিধি এবারের জোড়ে অংশ নিয়েছেন। তাদের অনেকেই বিশ্ব ইজতেমা পর্যন্ত বাংলাদেশে তবলিগের কাজে নিয়োজিত থাকবেন।

মূলত এই জোড় শেষ হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় বিশ্ব ইজতেমার কাজ। এখান থেকেই নির্ধারণ করা হবে মোট কতটি জামাত মাঠে থাকবে প্যান্ডেল নির্মাণের কাজে। এর বাকি জামাতগুলোকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। সেখান থেকে তারা গাশত করে আগামী বছরের জন্য ১ চিল্লা, ২ চিল্লা, ৩ চিল্লা বা এক বছরের জন্য লোক তাশকিল করে মাঠে নিয়ে আসবেন। তারা ইজতেমার তিন দিন মাঠে অবস্থান করে চলে যাবেন দাওয়াতের কাজে।

বিশ্ব ইজতেমা সূত্র জানিয়েছে, এবারই প্রথমবারের মতো ইজতেমা দু'পর্বে মোট ছয় দিন চলবে। তবলিগ জামাতের মজলিসে শূরায় গত বছরই ২০১১ সাল থেকে দু'দফায় বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী এবার ইজতেমার প্রথম পর্ব ২১ থেকে ২৩ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় পর্ব ২৮ থেকে ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। প্রথম দফায় ৩২ জেলা এবং দ্বিতীয় দফায় বাকি ৩২ জেলার লোক এতে অংশ নেবেন। তবে ঢাকা জেলার লোকজনকে ২১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত বিরতির দিনসহ মাঠেই থাকতে হবে। এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়নি কোন কোন জেলা কোন পর্বে অংশ নেবে।

মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় লাখ লাখ মুসলিল্গ খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নেন। এই দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করেই আগত মুসলিল্গদের সুবিধার্থে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উভয়পর্বে বিদেশি মুসলিল্গরাসহ শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে-কেরামরা উপস্থিত থাকবেন।

এদিকে বিশ্ব ইজতেমা তিন দিনের পরিবর্তে দু'ভাগে ছয় দিন করার প্রস্তাবকে সরকার পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে। সরকার ব্যাপক জনদুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে বিশ্ব ইজতেমা তিন দিনে সীমাবদ্ধ রাখতে ইজতেমা আয়োজকদের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে। সরকারের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সার্বিক বিষয় বিবেচনায় মুরবি্বরা আলোচনার জন্য শিগগিরই সরকারি পর্যায়ে বৈঠকে বসবেন বলে জানা গেছে।

'ইজতেমা' শব্দের অর্থ সমবেত করা, সভা-সমাবেশ বা সম্মেলন। ধর্মীয় কোনো কাজের জন্য মানুষকে একত্র করা, কাজের গুরুত্ব বোঝানো, কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ব্যাপকভাবে এর প্রচার, প্রসারের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা ইত্যাদি বিষয়কে ইসলামের পরিভাষায় ইজতেমা বলা হয়ে থাকে। হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) মুখ নিঃসৃত বাণী 'আমার পক্ষ হতে মানুষকে পেঁৗছাতে থাক যদিও একটিমাত্র আয়াত হয়'_ এই হাদিসের আলোকে টঙ্গীতে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে তবলিগ জামাতের উদ্যোগে বিশ্ব ইজতেমা।

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-শহর-বন্দর থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এই ইজতেমায় শরিক হন। একই সঙ্গে বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশ থেকে আগত হাজার হাজার তবলিগ অনুসারী ইমানদার মুসলিল্গ মিলিত হন। তারা কোনো রকম বৈষয়িক লাভের আশা না করে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দ্বীনের মেহনত করে ইজতেমা ময়দানকে মুসলিম মহামিলনের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন।

ইসলাম প্রচারে তবলিগ জামাতের মুসলিল্গদের আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বানের যে নিরন্তর প্রচেষ্টা, যে গভীর আন্তরিকতা এরই এক প্রাণবন্ত বহিঃপ্রকাশ বিশ্ব ইজতেমা। ধর্মের কাজে তারা একদিকে নিজেকে পরিশুদ্ধ ও উন্নত করার জন্য, অন্যদিকে যারা উদাসীন তাদের ধর্মের প্রতি আহ্বান করতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন। দুনিয়া ও আখিরাতে মানুষের আত্মিক প্রশান্তি লাভের জন্য ইজতেমা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিল্গরা আল্লাহর দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাগলপারা ও নবীপ্রেমিক হয়ে ঘরবাড়ি, আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে বিশ্ব ইজতেমায় একত্র হন। বিশ্ববরেণ্য আলেম-ওলামা ও ধর্মীয় নেতারা বিশ্ব ইজতেমায় শামিল হয়ে ইসলামের শাশ্বত বাণী বয়ান করেন এবং মানুষকে ধর্মের পথে জীবন পরিচালনার জন্য উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানান। বিশ্ব ইজতেমার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, দেশ-বিদেশের আলেম-ওলামাদের কাছ থেকে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে দ্বীনের বয়ান শুনে ইমান-আমলের দাওয়াত সারাবিশ্বে পেঁৗছে দেওয়া।

শুধু ধর্মীয় বয়ান শোনা বা বিশ্ববাসীর শান্তি ও হেদায়েতের জন্য আখেরি মোনাজাতে প্রচুর লোকের অংশগ্রহণ বিশ্ব ইজতেমার উদ্দেশ্য নয়, বরং যাতে বেশি জামাত দ্বীনের কাজে বের হয় এর দিকনির্দেশনা এখানে প্রদান করা হয়। যেন প্রতিটি জামাত নির্ধারিত এলাকার মসজিদে দু'তিন দিন করে অবস্থান করে তবলিগের ছয় উসুল_ কালেমা, নামাজ, এলেম ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন ও সহিহ নিয়ত তবলিগসহ তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত, ইমান এবং আমলের দাওয়াত দেয়।

পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যাপক ও গতিশীল ইসলামী আন্দোলনের একটি প্রধান ধারা দাওয়াতে তবলিগ। তবলিগের সঙ্গীরা জামাত বেঁধে মানবতার টানে আল্লাহর প্রেমে মসজিদ থেকে মসজিদে সফর করেন, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যান, মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সবিনয়ে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেন, জামাতে নামাজ আদায়ের কথা বলেন, পরোপকার শিক্ষা দেন, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও ধর্মীয় শিক্ষার কথা বলেন, নিয়ত পরিশুদ্ধির কথা বলেন। এমন অনেক মুসলমান আছেন, যারা তবলিগ জামাতের মাধ্যমে সত্যিকারের দ্বীন শিক্ষা ও পরহেজগারি অর্জন করেছেন এবং ধর্মীয় বিষয়াদি সম্পর্কে শিক্ষিত ও সচেতন হয়েছেন। আর এ ধারাকে আরও বেগবান করতে আগামী বছরের নতুন ধারার বিশ্ব ইজতেমার দাওয়াত পেশ করা হলো সবাইকে।
muftianaet@gmail.com 
 
সৈজন্যে: দৈনিক সমকাল