Monday, May 14, 2012

শক্তিমান তিন নেতা ও স্মৃতিময় ধানগড়া -ব ঙ্গ বী র কা দে র সি দ্দি কী বী র উ ত্ত ম

সৈজন্যেঃ দৈনিক আমারদেশ

মে মাসের ৪, ৫ ও ৬ তারিখ ছিল বাংলাদেশের জন্য এক রাজনৈতিক সুনামি। ৪ তারিখ এলেন জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী, ৫ তারিখ দুপুরে পরাশক্তিধর আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, রাত ৯টায় ভারতের বর্ষীয়ান নেতা অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি।

সরকার এবং প্রধান বিরোধী দলের তত্পরতার শেষ ছিল না। জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তা ছিল অর্থনীতির ওপর। অর্থনীতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অবশ্যম্ভাবী হলেও আগ বাড়িয়ে কোনো উপদেশ দেননি। তবে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে কড়কড়ে সত্য বলেছেন। বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমস্যাটি আগে মিটিয়ে ফেলা উচিত। জাপানের একার পক্ষে পদ্মা সেতুর সম্পূর্ণ অর্থ যোগান সম্ভব নয়।

আমরা কেন যেন বোঝেও বোঝার চেষ্টা করি না। ভিক্ষা করে কি রাজরাজড়ার মেজাজ দেখানো সম্ভব? একেবারেই না।

হিলারি ক্লিনটন মনে হয় ২০-২২ ঘণ্টা ছিলেন। ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির আসার কথা চলছিল প্রায় দুই-তিন মাস থেকে। তাই হোটেল সোনারগাঁওয়ে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল বহু আগে। শুনেছিলাম এক বনে দুই বাঘ থাকে না। এবার দেখলাম এক হোটেলে দুই দেশের মন্ত্রীও থাকে না বা থাকতে পারে না। কেন যে পৃথিবীর মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনে—ব্যাপারটি কোনোমতেই মিলছে না।

ইদানীং তো কূটনৈতিক খেলায় গোল দিলেও জিত, গোল খেলেও জিত। তা না হলে সমুদ্র সীমা বিজয়ের বাহানায় বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে বলে কত উত্সব হলো! অন্যদিকে যে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ তারাও আচ্ছা করে বিজয় দিবস পালন করল। যাক তবুও শান্তি সুস্থিতি বজায় থাকলেই হলো। তবে কূটনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষ মনে করে আমেরিকা না আওয়ামী লীগ, না বিএনপির দিকে। কিন্তু ভারতে কংগ্রেস সরকার হলে চোখ-কান বুজে আওয়ামী লীগ।

এইবারই প্রথম বর্ষীয়ান নেতা প্রণব মুখার্জি একটা প্রণিধানযোগ্য কথা বলেছেন। তা হলো কোনো দলের সঙ্গে নয়, ভারত চায় বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক। তাই যদি হয় তাহলে ভারতে যাওয়ার জন্য যে ভিসার গজব সেটাকে তো একটু সহজ ও সুন্দর করতে হবে। সীমান্তে ফেলানীদের যখন তখন গুলি করে মারা যাবে না। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে হবে। সেই কবে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় পাঁচ লাখ টন চাল দেয়ার কথা ছিল। এখন পর্যন্ত এক ছটাকও দেয়া হয়নি। প্রায় দেড় বছর হয় একশ’ কোটি ডলার ঋণচুক্তি হয়েছে। তার এক টাকাও পাওয়া যায়নি। এরকম হলে তো কেউ কাউকে বিশ্বাস করবে না।

বয়স তো আর কম হলো না। পাকিস্তান আমলেও রাস্তাঘাটে যতটা না ভারত বিদ্বেষ দেখা গেছে, বর্তমানে ভারতের প্রতি নতজানু সরকারের আমলে তার চেয়েও হাজার গুণ বেশি দেখা যাচ্ছে। কাকের মতো চোখ বন্ধ করে রাখলে কোনো সমাধান হবে না। চোখ-কান খুলে নিরাসক্তভাবে সবকিছু দেখে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। ইদানীং শোনা যাচ্ছে, ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া তাও নাকি ভারতের কারসাজি। এই অঞ্চলের মানুষ যখন কোনো কিছু বলতে শুরু করে তা কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ে।

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিদেশি নাগরিক গওহর রিজভী ও ড. মশিউর রহমান এতদিন জোর দিয়ে বললেন, তিস্তা চুক্তি হবে, পানির ন্যায্য হিস্যা পাব। এবার তো দিল্লি পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে, এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে  কোনো অগ্রগতি না হলে তিস্তা চুক্তি সম্ভব না।

আমাদের কী দুর্গতি। একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে এতিমের মতো বসে থেকে একটি রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। সামান্য মর্যাদাবোধ থাকলে ওখান থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র লিখে নিয়ে আসতেন।

রাজস্থানের রাজপুত নারীদের সম্পর্কে শুনেছি, তাদের পুরুষরা কোথাও যুদ্ধে গিয়ে পরাজিত হলে শত্রুর হাতে পড়ে সম্ভ্রম হারাবেন আশঙ্কায় জহরব্রত পালন করে আত্মহত্যা করতেন। এই পৃথিবীতে এখনও অনেকে আছে, সম্মানের জন্য জীবন দেয়, আবার কেউ কেউ সামান্য লাভের জন্য সম্মান দেয়।

যাক এখন আর মান-মর্যাদার কথা বলে কোনো লাভ নেই। তা না হলে কত তেল মর্দন করে, ফুলচন্দন দিয়ে মিসেস হিলারিকে বাংলাদেশে আনা হলো। সফর শেষ হতে না হতেই অর্থমন্ত্রী হাত-পা ছুড়ে কটমট করে যা বললেন, তা কিন্তু শাশ্বত বাঙালির কৃষ্টি-সভ্যতা নয়। আমাদের সভ্যতায় অতিথিকে কটুবাক্য প্রয়োগের নজির নেই, বরং অতিথির কটুবাক্য সহ্য করার বহু নজির আছে। নোবেল পাওয়ার জন্য ড. ইউনূসকে পছন্দ না হলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু তাই বলে জাতীয় ঐতিহ্য নষ্ট করতে হবে এটা কেমন কথা? অর্থমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সময় থেকেই সুবিধায় থাকতে থাকতে মনে হয় বেপরোয়া হয়ে গেছেন। তা না হলে একজন সম্মানিত বিদেশি অতিথি সম্পর্কে অমন বলতে অবশ্যই রুচিতে বাঁধতো। তিনি একক ব্যক্তি হিসেবে অমনটা করলেও গ্রহণযোগ্য হতো না। উপরন্তু রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে অমনটা করেছেন, তাই এ ব্যাপারে অবশ্যই তার জাতির সামনে জবাব দেয়া উচিত। এ ব্যাপারে দেশবাসীকে সোচ্চার হতে আহ্বান জানাচ্ছি।আমরা একটা চরম অস্বস্তিকর সময় অতিক্রম করছি। তাই সবার কাছে আশা করব, আমরা প্রত্যেকেই যদি নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সামান্য সচেষ্ট হই তাহলে জাতির এই ক্রান্তিকাল অবশ্যই দূর হতে বাধ্য।


গত পর্বে ধানগড়ার নাজির হোসেনের স্ত্রীর ইন্তেকালের কথা লিখেছিলাম, এ ব্যাপারে আর একটু অগ্রসর হতে চাই। কারণ সেটা আমার হৃদয়ের অনেকটা জায়গাজুড়ে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক কথা সেটা। তাই প্রিয় পাঠক, সেই প্রসঙ্গটা শেষ করে আসি।

বিকাল সাড়ে ৫টায় মোহাম্মদপুর থেকে রওনা হয়ে সাড়ে ৮টায় ধানগড়ায় নাজির হোসেনের বাড়ি পৌঁছি। আষাঢ়ের বৃষ্টির মতো সেদিনও করটিয়া-টাঙ্গাইলে ব্যাপক ঝড়-তুফান হলেও এলেঙ্গার পর কোনো ঝড়-বৃষ্টি ছিল না। কালিহাতীতে দেখলাম মেঘের ডাকাডাকি আছে কিন্তু একফোঁটা বৃষ্টি নেই। নাগবাড়ী থেকে ধানগড়া রাস্তা ভালো নয়। আগে পায়ে হেঁটেও যাওয়া যেত না। নাগবাড়ী আবুল হাসান চৌধুরীদের বাড়ির সামনে একটা ছোট কালভার্টের কাজ হচ্ছে। পারাপার এমন দুর্গম করা হয়েছে, যা অবিশ্বাস্য। তবুও গাঁজার নৌকা যেমন পাহাড় দিয়ে যায় আমার গাড়িও তেমনি সব জায়গা দিয়েই যায়। ’৯০-এ গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে ফিরলে এদেশের একজন মহত্প্রাণ শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম ঢাকা মেট্রো ভ-৭৭০০ একটা ২৬০০ সিসির রকি জিপ আমায় উপহার দিয়েছিলেন। শুধু রকি জিপ নয়, সেই ’৬২-র পর থেকে আমৃত্যু কত হাজার হাজার লাখ লাখ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন তার কোনো হিসাব নিকাশ নেই। কিন্তু কোনো দিন কোনো তদবির নিয়ে আসেননি। শুধু একবার বিএনপি সরকারের আমলে তাদের কয়েকটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিলে কয়েক মাস আওয়ামী লীগের মাসোহারা দিতে পারবেন না সেটা একটু জননেত্রীকে জানাতে অনুরোধ নিয়ে এসেছিলেন। এছাড়া কোনো দিন আর অন্য কোনো কথা বলেননি। সেই গাড়ি দেশের কোনো আতর-বাতর, খাল-খন্দ, নদী-নালা নেই যেখানে যায়নি। এমনকি বুক সমান পানির মধ্য দিয়েও ধলেশ্বরী নদী পার হয়েছে। ইদানীংকালের গাড়িঘোড়া তেমন শক্তিশালী নয়। তবু আমি যে গাড়ি চালাই সে গাড়ি জানে হাইল্যা, জাইল্যার হাতে পড়লে কেমন হয়। তাই তেমন ওজর-আপত্তি করে না, সুড়সুড় করে সব জায়গা দিয়ে চলে। সেদিনও কাদা পানি ভেঙে আমাকে নিয়ে তাকে ধানগড়া যেতে হয়েছিল। নাগবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রানা সিদ্দিকী, বাংড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হাসমত আলী নেতা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদার বীর প্রতীক, টাঙ্গাইল জেলা সভাপতি এএইচএম আবদুল হাই, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলামসহ ৪০-৫০ জন সঙ্গে ছিল।

আমি যখন ধানগড়া পৌঁছি তখন নাজির হোসেন জায়নামাজে ছিলেন। ঘরভর্তি মানুষ। এলাকার সবার কাছে আমি যেমন পরিচিত তারাও আমার কাছে। বাড়ির ছেলে মেয়েরা আমার সন্তানের মতোই। ও বাড়িতে আমার কত যে নাতিপুতি হিসাব মেলানো ভার। কারও দাদা, কারও নানা, ভাই, চাচা, মামা সম্পর্কের শেষ নেই। বছরে দু’একবার ধানগড়ায় যাওয়া হয়। সেদিন যে ঘরে গিয়ে বসেছিলাম ওখানেই ৪১ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা ভাঙা ঘর ছিল। নাজির হোসেনের দু’হাত চেপে ধরে বুকে টেনে নিতে কত কথা মনে পড়ে গেল।

১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল প্রথম ওবাড়ি গিয়ে প্রায় বিশ-পঁচিশ দিন পর মা-বাবা, ভাইবোনদের দেখা পেয়েছিলাম। সেই সব স্মৃতি সিনেমার পর্দায় ভেসে ওঠা ছায়াছবির মতো একেক করে মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল। ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনী বীর বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত মা-বাবা, ভাইবোন টাঙ্গাইলেই ছিলেন। ২৫ মার্চ মাকে গ্রামের বাড়ি রেখে আসি। বাবা মোটরসাইকেল নিয়ে ছাতিহাটি টাঙ্গাইল ঘোরাফেরা করতেন। ৩ এপ্রিল যেদিন গোড়ান-সাটিয়াচরা যুদ্ধ হয় সেদিন বাবা ছাতিহাটি গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন। অস্ত্র নিয়ে পাহাড়ে যাওয়ার সময় মা-ই প্রায় একশ’জনের খাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। ওর পরে কত পাহাড় ভর করেছি, সীমান্তের কাছে ফুলপুর থানার ওসি মমতাজ অবাঙালি বলে ১৪-১৫ জন সহকর্মীসহ একদিন বন্দি করে রেখেছিল। এরপর আবার ফিরে এসে আশ্রয়হীনভাবে কত জায়গায় ঘোরাফেরা করেছি। মাঝে মধ্যে মা-বাবা, ভাইবোনের কথা মনে হয়েছে। কেউ বাবাকে দেখেছে, কেউ ছোট ভাইদের। মনে মনে সান্ত্বনা পেয়েছি, ভেবেছি, রাস্তাঘাটহীন গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা ভালোই আছেন। কিন্তু আমি মোটেই ভালো নেই। এক সময় আমরা অনেক ছিলাম। কিছুই করতে পারছি না বলে ৭-৮ দিন আগে সবাইকে বিদায় করেছি। কিন্তু সিলেটের ফারুক ও ইকবাল তখনও পিছু ছাড়েনি। দু’দিন পর সেই ইকবালকেও পিছু ছাড়া করেছি। সঙ্গে তখন শুধু একমাত্র ফারুক, ১৭ এপ্রিল দুপুরে উপলদিয়ার ফজলুদের বাড়িতে খেতে বসেছি। আমরা তখন সবাই মাটিতে পিঁড়িতে বসে খেতাম। ৬-৭ জনকে খাওয়াচ্ছিলেন। হঠাত্ ফজলুর ছোট ভাই ১০-১২ বছরের রঞ্জু বলল, ‘মা, বজ্র ভাইর ছোট ভাই বেল্লালকে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখলাম।’ কথাটা শুনে কেমন যেন বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। ‘বেল্লালকে তুই কোথায় দেখলি?’
— দেওপাড়ার কাছে।
— সত্যিই তুই দেখেছিস?
— হ্যাঁ, বেল্লালকে চিনব না?
— কথা বলেছিস?
— না, দুলাভাইয়ের বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম, তখন রাস্তা দিয়ে বেল্লালকে কাঁদতে কাঁদতে যেতে দেখলাম। আমি আর সাহস করে এগিয়ে যাইনি।

বেল্লাল আমার থেকে চারজনের ছোট। তখন ওর আর বয়স কত— বারো-তেরো হবে। কান্নাকাটি আমাদের বাড়িতে নতুন কিছু নয়। একশ’জন মিলেমিশে কাঁদলেও আমার সমান হবে না। বাবার পিটুনি খেয়ে কেঁদেছি। বড় ভাইয়ের মার খেয়ে কেঁদেছি। মায়ের কাছে এটা-ওটা বায়না ধরে না পেয়ে কেঁদেছি। স্কুলে শিক্ষকদের বেত খেয়ে কেঁদেছি। ছেলেবেলায় আমার কাঁদার অন্ত ছিল না। কিন্তু তারপরও হঠাত্ করে ছোট ভাইয়ের কান্নার কথা শুনে বুক খান খান হয়ে গিয়েছিল। ভাত আর মুখে যাচ্ছিল না। কেমন যেন গলা শুকিয়ে আসছিল। তখনই ফজলুর মাকে বলে বিদায় নিয়েছিলাম। তিনি বিদায় দিতে চাননি তবুও নিয়েছিলাম।

ভরদুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। চিরসঙ্গী ফারুক আর ফজলু ও রতনপুরের ফারুক এগিয়ে দিতে এসেছিল। ওদের বাড়ি থেকে প্রায় চার-পাঁচ মাইল পুবে নজরুলদের কাছতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। এরপর দু’জন হাঁটতে হাঁটতে আমাদের সবচেয়ে দরিদ্র আত্মীয় ভোজদত্তের ফুপা মোকাদ্দেছ আলী খানের বাড়ী গিয়েছিলাম। আমাদের এই ফুপু গরিব হলেও আমাদের সবচেয়ে বেশি আদর-যত্ন করতেন। তার আদর ভালোবাসায় কোনো উজান-ভাটি দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেই চরম দিনগুলোতেও না। এমনিতে তাদের দিন এনে দিন খাওয়ার অবস্থা। কিন্তু তবু আমরা গেলে কী যে আদর-যত্ন করতেন। কোনো দিন মোরগ-মুরগি জবাই করে না খাইয়ে ছাড়তেন না। সেদিনও ছাড়েননি। বুঝতাম আমি তার ভাইয়ের ছেলে। তাই অত আদর। কিন্তু তখন যে প্রতিদিনই পাকিস্তান হানাদাররা আমার মাথার দাম লাখ টাকা ঘোষণা করে চলেছে। ধরে দিলেই লাখ টাকা পুরস্কার। আশ্রয় দিলে জীবননাশ। তারপরও তিনি ছাড়লেন না। ভাইপোকে খাওয়াতেই হবে। রাত ৯টার দিকে ছাড়া পেলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা গ্রামের বাড়ি ছাতিহাটির দিকে রওনা হলাম।
(চলবে)

পূর্বের অংশ

সোমবার ০৭ মে ২০১২

দুই মহান অতিথির কাকতালীয় সফর
-বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম

গত ৫ মে ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি বিশেষ দিন। একদিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্ষমতাধর দেশ আমেরিকার ক্ষমতাধর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন চায়নার বেইজিং থেকে কলকাতা হয়ে দিল্লি যাওয়ার পথে সরাসরি ঢাকায় আসেন, অন্যদিকে ভারতের বর্ষীয়ান নেতা বাঙালি ও বাংলাদেশের সুহৃদ ভারতের প্রবীণ অর্থমন্ত্রী শ্রী প্রণব মুখার্জী আসেন ম্যানিলা থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে সরাসরি দিল্লি যাওয়ার পথে ঢাকায়। একজন ওঠেন সোনারগাঁওয়ে, অন্যজন গুলশানের ওয়েস্টিনে। জানি না দুই পরাশক্তির ক্ষমতাধর নেতাদের একই সময় ঢাকা সফর কাকতালীয় কিনা। তবু লোকজন বলাবলি করছে ওয়াশিংটন গিয়ে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাত্ পাননি। এমন কী হলো যে তিনি ঢাকায় এসে সাক্ষাত্ দিয়ে গেলেন। একি আমাদের জন্য সুসংবাদ, নাকি কোনো দুঃসংবাদের ইঙ্গিত? অল্প কিছুদিনে দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গন ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ঘুষ, দুর্নীতি, গুম, নির্যাতন গণতন্ত্রের পথে এক বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। ইলিয়াস আলীর ছোট্ট মেয়ে হিলারি ক্লিনটনের হাতে তার যে আবেগমথিত স্বহস্তে লিখিত পত্র দিয়েছে তা পড়ে বিশ্ব মানবতার হৃদয় কেঁপে না উঠে পারে না। দুই অতিথি যেমন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছেন, দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক, আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, তেমনি বিরোধী দলের নেতার সঙ্গেও করেছেন। সবাইকে নিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে অক্ষুণ্ন রাখা এটা কি শক্তিধর রাষ্ট্রের আমাদের প্রতি অনুরোধ না নির্দেশ কিছুদিনের মধ্যেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। অন্যদিকে বেশ রাতে ভারতের প্রবীণ রাজনীতিবিদ শ্রী প্রণব মুখার্জী ঢাকায় আসেন। তার সঙ্গে রাতেই আমার দেখা হয়। বছরখানেক আগেও তার শরীর-স্বাস্থ্য যেমন দেখেছি তেমনটা দেখলাম না। সেই কবে ’৭৭ থেকে তার সঙ্গে পরিচয়। একদিনের জন্যও সম্পর্কের কোনো ভাটা পড়েনি। গতবার যখন কয়েক ঘণ্টার ঝটিকা সফরে আসেন তখন তাকে দিল্লিতে ফোনে পেয়েছিলাম। ছেলেমেয়েরা দেখা করবে বলতেই তিনি তখনকার ভারতীয় হাই কমিশনার রজিত মিতারকে ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন। যাওয়ার পথে খুব সংক্ষিপ্ত সাক্ষাত্। তাও আধ ঘণ্টার বেশি সময় কেটে গিয়েছিল। ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। দীপের যখন দেড়-দুই বছর বয়স তখন তিনি আমার বর্ধমানের বাড়িতে গিয়েছিলেন। দীপ তখন খুবই নাদুস-নুদুস ছিল। শুধু হাসত বলে তাকে কোলে নিয়ে আদর করে নাম দিয়েছিলেন সদানন্দ। এখনও ওনামেই ডাকেন। আমার ছেলে-মেয়েদের দু’পাশে নিয়ে কথা বলতে বলতে অনেক সময় কেটে গিয়েছিল। সেদিন আওয়ামী লীগের নেতা আমীর হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ ও শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। প্রণবদার আসতে যতটা সময় লেগেছিল সেই সময়টুকু মান্যবর হাই কমিশনারের স্ত্রী আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে যে খেলাধুলা করেছিলেন তা অভাবনীয়। এবারও প্রণবদার ঢাকা সফরের আগের দিন ফোন করে কথা বলতে গিয়ে বিস্মিত হয়েছিলাম। তিনি দিল্লিতে নেই। বাইরে গেছেন সেখান থেকেই বাংলাদেশ হয়ে ফিরবেন। তাই আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। ৫ মে রাত সাড়ে দশটায় সরাসরি সোনারগাঁওয়ে গিয়েছিলাম। সাধারণত যোগাযোগ না করে খুব একটা কোথাও যাই না। হোটেলে ঢুকতেই রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হলো। দায়িত্বশীল কেউ একজন এসে বললেন, ‘অতিথি আসছেন, কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।’ দশ-বারো মিনিট গাড়িতেই ছিলাম। মান্যবর অতিথি তার স্যুটে গেলে হোটেলের গেটেই এক ভদ্রলোক সাদর সম্ভাষণ জানালেন। ‘আপনি এসেছেন শুনে দাঁড়িয়ে আছি। কারও সঙ্গে দেখা করবেন নাকি?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, মান্যবর মূল অতিথির সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি।’ দাদাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম, আমি এসেছিলাম, ছেলেমেয়েদের দেখার সুযোগ দিলে খুশি হব।’ চিঠি লেখা শেষ হলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মান্যবর অতিথির সফর সঙ্গী প্রদ্যুত গুহ আছেন কিনা?’ রিসেপশনিস্ট তত্ক্ষণাত্ বললেন, ‘হ্যাঁ, ৮১১ নম্বর কক্ষে তিনি আছেন।’ রিং দিতেই তাকে পাওয়া গেল। আমি হোটেলের নিচে এসেছি বলতেই প্রদ্যুত গুহ, ‘বাঘাদা কেমন আছেন’ বলে মনে হয় লাফিয়ে উঠল। বললাম, ‘আগে যোগাযোগ করতে পারিনি, দেখা করতে চাই।’ বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি এখনই জানাচ্ছি। উনি অ্যাম্বাসির লোকজনের সঙ্গে কথা বলছেন। কথা শেষ হলেই আপনাকে বলছি।’ আরও মিনিট দশেক লবিতে ছিলাম। প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা লে. কর্নেল এটিএম মহিউদ্দিন সেরনিয়াবাত পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। গত ৩৫ বছর প্রণবদাকে যেভাবে জেনেছি তাতে বার বার মনে হচ্ছিল তক্ষুণি হয়তো আমাদের ফিরতে হবে। রাত তখন এগারোটা কয়েক মিনিট। একেবারে বাসার গেটে। প্রদ্যুত গুহের ফোন এলো, ‘বাঘাদা, আপনি কোথায়? আমি লবিতে।’ বললাম, ‘আমি তো বেরিয়ে এসেছি।’
—এক্ষুণি চলে আসুন। আপনার সঙ্গে কথা বলে দাদা স্নানে যাবেন।

কী করা! আবার গাড়ি ঘুরালাম। ফরিদ দৌড়ে গিয়ে এবার বইমেলায় প্রকাশিত আমার দু’টি বই ‘বজ্রকথন’ ও ‘তারা আমার বড় ভাই-বোন’ নিয়ে এলো। কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা ত্রিশ মিনিটে সোনারগাঁওয়ে ঢুকলাম। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে গেল মান্যবরের স্যুটে। গিয়ে দেখি প্রণবদার সফর সঙ্গী জহুর সরকার বসে আছেন। আমি যখন বর্ধমানে ছিলাম তিনি তখন বর্ধমানের ডিএম। আমাদের দেশে যেখানে জেলা প্রশাসক বলে, ওখানে তাকে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বলে। প্রণবদা স্নান করতে ঢুকেছিলেন। মিনিট পনের পর তাকে দেখতে পেলাম। অন্য সময়ের চেয়ে তাকে শ্রান্ত-ক্লান্ত ও একটু দুর্বল মনে হলো। আরও কয়েকজন আমাদের দেশের নাগরিক ছিলেন। চমচম নিয়ে এসেছি বলে তারা তাদের কিছু প্রয়োজনীয় কথা বলতে চাচ্ছিলেন। বললাম, ‘চমচম ওটা আমার আনার জিনিস। আমি যাই, আপনারা কথা বলুন।’ প্রণবদাকে দু’টি বই দিয়ে বললাম, ‘ছেলেমেয়েরা দেখতে চায়।’ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘কাল দু’টার পর ওদের নিয়ে এসো।’ চলে এলাম হোটেল থেকে। সারাপথ মনে মনে ভাবলাম আমরা এত নিকট প্রতিবেশী কিন্তু আমাদের সমস্যার অন্ত নেই। তিস্তার পানি, টিপাই বাঁধ, ট্রানজিট; আরও কত কী! আন্তরিক হলে এসব কি সমাধান করা যায় না? হয়তো যায়। কিন্তু কেন যায় না? ইদানীং বাংলাদেশে যা কিছু হচ্ছে বাতাসে শোনা যায় সবই নাকি ভারতের কারসাজি। মানুষ কেন যেন পাকিস্তান আমলে যতটা না ভারতবিদ্বেষী ছিল তার চেয়ে বেশি বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে যা টিক্কা-ইয়াহিয়ার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কীভাবে যেন তাদের প্রেতাত্মারা আজ তা করতে সক্ষম হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের উভয় দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কারও কি কিছু করার নেই? ভারত কি শুধু বাংলাদেশের কোনো দলের, নাকি দেশের জনগণের? কেন যেন প্রশ্নগুলো বারবার নাড়া দেয়। আন্তরিকভাবে এখনই এসবের সমাধান না খুঁজলে কারও জন্য ফলাফল ভালো হবে না।

এপ্রিলের এক অংশ বাংলা বর্ষের শেষ, অন্য অংশ শুরু। কত জনমের আশা ছিল এবারের বাংলা বছর মোটামুটি মানবের হবে, নির্মল হবে। কিন্তু না শুরুটাতে তার লেশমাত্রও দেখতে পাচ্ছি না। কেমন যেন শঙ্কাময় অস্বস্তিকর ভয়াবহ গুমোট পরিবেশ। চারদিকে সব বড় বড় অঘটনের আলামত। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও অনেকটা এমন ছিল। ৩ এপ্রিল প্রথম আমরা গোড়ান-সাটিয়াচরায় পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধ করেছিলাম। ঢাকার বাইরে হানাদাররা প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল। কিন্তু আমরা তছনছ হয়ে গিয়েছিলাম। বিভীষিকাময় সেদিনের কথা মনে হলে আজও বুকে কাঁপন ধরে। ঢাকার দিক থেকে পালিয়ে যাওয়া আশ্রয় নেয়া শতাধিক এবং গোড়ান-সাটিয়াচরার স্থায়ী বাসিন্দা আরও শতাধিক নিহত হয়েছিল সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে। কৃষক শ্রমিক ছাত্র নিয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনীর ১৩-১৪ জন এবং ইপিআরের মধ্য থেকে আরও ১২-১৩ জন শহীদ হয়েছিল। ছাত্রদের মধ্যে গোড়ানের জুমারত আলী দেওয়ান ছিল প্রথম শহীদ। তেমনি ইপিআরের হাওলদার বগুড়ার আব্দুল খালেক ছিল টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ। কতজন কত খেতাব পেয়েছে কিন্তু সেদিনের এই অসম সাহসী যোদ্ধা তার নাম কোথাও আছে কিনা বলতে পারব না। তিনি ময়মনসিংহ থেকে এসে টাঙ্গাইলের প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তখনও কাদেরিয়া বাহিনী গঠিত হয়নি। টাঙ্গাইল গণমুক্তি পরিষদ গঠিত বাহিনীর অধীনে ছিলাম। তাই যুদ্ধ শেষে যেমন জুমারত আলী দেওয়ানের জন্য কোনো সুপারিশ পাঠাইনি, তেমনি ইপিআরের হাওলাদার আব্দুল খালেক সম্পর্কেও নয়। তাই তারা অবহেলায় অতলে তলিয়ে গেছে। অথচ যেসব সুপারিশের উপর ভিত্তি করে বীর উত্তম, বীর বিক্রম, বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেয়া হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি প্রথম প্রতিরোধে হাওলাদার আব্দুল খালেক দেখিয়েছিলেন। টাঙ্গাইলের বর্তমান জেলা পরিষদ প্রশাসক জনাব ফজলুর রহমান খান ফারুক ছিলেন মির্জাপুরের এমপি। তিনি আবদুল খালেকের বাংকারে ২ এপ্রিল রাতে ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে জোর করে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেন। প্রথম প্রথম ফজলুর রহমান সরতে চাননি। কিন্তু হাওলাদার তাকে বলেছিলেন, ‘আমরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক। একটা কিছু করতেই পারব। আপনার কোনো ট্রেনিং নেই, আপনি একজন নেতা, আপনি মারা গেলে দেশের অনেক ক্ষতি হবে। চলে যান আমার বাংকার থেকে।’ ফজলুর রহমান খান সেখান থেকে সামান্য একটু সরলেই আবদুল খালেকের লাইট মেশিনগান বিকল হয়ে যায়। বিকল মেশিনগান ঠিক করার চেষ্টা করতে করতেই হানাদারদের একঝাঁক মেশিনগানের গুলি এসে আবদুল খালেকের বুক ঝাঝরা করে দেয়। সে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়ে। কথাটা বললাম এজন্য যে, গত ৩০ এপ্রিল অন্যদিনের মতো মোহাম্মদপুরের বাড়ির বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলাম। ঢাকায় থাকলে প্রতিদিন সকালে সেখানে বসেই খবরের কাগজ পড়ি। একদিন ওখানে না বসলে কেমন যেন খালি খালি লাগে। বিশেষ করে বারান্দার কাছে দুটি নারিকেল গাছ ’৭২ সালে মা বুনেছিলেন। এখন মস্তবড় হয়েছে। বারো মাস তাতে নারিকেল থাকে। বারান্দায় বসলে বাতাসে যখন লম্বা লম্বা ডালগুলো নড়ে, তখন কেন যেন শুধু শুধু মা’র কথা মনে হয়। মনে হয় মা’ই যেন কত কথা বলছে। হাত বাড়িয়ে আছে সন্তানকে আদর করার ভঙ্গিমায়। সেদিনও তেমনি বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলাম। হঠাত্ই কাজের ছেলে এসে বলল, ‘আপনাদের ধানগড়ার নাদু ভাইর বৌ মারা গেছে।’ বয়স হয়েছে এখন কোনো মৃত্যু সংবাদ খুব বেশি আকুল করে না। কিন্তু আপনাদের ধানগড়ার নাদু ভাইর বৌ মারা গেছে—খবরটা শুনে বুকের ভেতর ছ্যাত্ করে উঠেছিল। মুহূর্তে কেমন যেন হয়ে গেলাম। ধানগড়ার নাজির হোসেন নাদু, তারা আমার রক্তের কেউ নন। তারা কারিগর সম্প্রদায়। আর ইয়ামেন থেকে আসা পূর্বপুরুষের আওলাদ বুনাদ আমরা। তারপরও তার মৃত্যু সংবাদ আমাকে অমন করে আকুল করল কেন? ১৮ দলের ডাকা ২য় বারের হরতালের ২য় দিন না থাকলে তখনই নাজির হোসেন নাদুর স্ত্রী হাফছা খাতুনের দাফনে শরিক হতে ধানগড়া যেতাম। কিন্তু হরতালের কারণে তক্ষুণি যাওয়া হয়নি। মৃত্যু সংবাদ শোনার পর মন বড় অশান্ত হয়ে গিয়েছিল। কোনো কাজেই মন বসছিল না। গত কয়েক বছর দেহমন কোনোকিছুতে শান্ত করতে না পারলে শেষমেষ কাগজপত্র এবং বই-পুস্তক হাতাহাতি করি। তাতে অনেকবার দেখেছি হঠাত্ হঠাত্ এমন সব জরুরি কাগজপত্র পেয়ে যাই যা দেখে দুঃখের কথা আর কিছুই মনে থাকে না। সেদিনও তেমনি হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে বিদেশবিভূঁইয়ে নির্বাসনে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের উপর স্বাধীনতা ’৭১ বই লিখতে গিয়ে সেই সময় অনেক নেতাকর্মীর সাক্ষাত্কার নেয়া হয়েছিল। প্রায় তিনশ’ রেকর্ডকৃত সাক্ষাত্কারের মধ্যে গোড়ান-সাটিয়াচরার প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে ফজলুর রহমান ফারুকের রেকর্ড করা সাক্ষাত্কারটি ছিল। যা আমি ৬-৭ বার কাটছাঁট করে একটি বইয়ের আকারে পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছি। সেই সাক্ষাত্কারগুলো পড়তে পড়তে হঠাত্ করেই ফজলুর রহমান ফারুকের সেদিনের সেই হাওলাদার খালেকের ঘটনা পড়ে অভিভূত হয়েছিলাম। কেমন করে নিজের জীবন বিপন্ন করে একজন নেতাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। এখন অনেকেই অনেক কথা অস্বীকার করে। তাই ফজলুর রহমানের সেই সাক্ষাত্কার তিনি আবার কি অস্বীকার করবেন? এই সন্দেহে ক্যাসেট বের করে দুই-তিনবার শুনে আরও অভিভূত হলাম। তিনি যে দরদ দিয়ে সেদিনের সেই ঘটনার উল্লেখ করেছেন আমাদের লেখায় তার তেমন কিছুই ফুটে ওঠেনি। শব্দ উচ্চারণে হৃদয়ের আবেগ থাকলে যে ভাবের সৃষ্টি হয়, হাজারবার লিখেও সে ভাব ফুটিয়ে তোলা যায় না। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। (চলবে)

পূর্বের অংশ

সোমবার ৩০ এপ্রিল ২০১২

সখিপুরে মহাপ্রলয় ও কঠিন রাজনৈতিক দুর্যোগ
-বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম

আমি নুহ নবীর (আ.) প্রলয় দেখিনি। কিন্তু বহু ঘূর্ণি দুর্বিপাক দেখেছি। স্বাধীনতার পর সিলেট, মানিকগঞ্জ ও ফরিদপুরের ঘূর্ণিদুর্গত এলাকায় অনেকদিন ত্রাণ পরিচালনা করেছি। এই তো কিছুদিন আগে ’৯৬ সালে মিরিকপুরের ঘূর্ণিঝড়ে বাসাইল-সখিপুরে মাসব্যাপী দুর্গত এলাকায় রাতদিন দুস্থদের সেবা করার চেষ্টা করেছি। গত ২১ এপ্রিল শনিবার রাতে সখিপুরের গজারিয়া, কালিয়া, কালমেঘা ও কাকড়াজান ইউনিয়নের ওপর দিয়ে আচমকা বয়ে যাওয়া কালবৈশাখী ও ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপক ধ্বংসলীলা এর আগে দেখিনি। গজারিয়া ইউনিয়নের বাঘবেড়, পাথারে হাজার হাজার গাছপালা ভেঙে গেছে। লাখো কলাগাছ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যে মাঠে হাজার মণ ধান ফলত, সেখানে এক কেজি ধানও কেউ পাবে না। খুবই আশ্চর্য হয়েছি গজারিয়া মুচারিয়া পাথারের সড়কঘাটা দরগারপাড় শাহ সুফি বদর উদ্দিন শাহ’র মাজার দেখে। যেখানে শীল পড়ে শত শত বাড়িঘরের টিনের চাল ঝাঁঝরা হয়ে ভেঙে খান খান হয়ে গেছে; সেখানে মাজারপাড়ে ঘরের আশপাশে প্রায় দশ-বিশ টন বরফ পড়েছে। অথচ মাজার ঘরের টিনের চালে একটা টোকাও লাগেনি। স্রষ্টার এ কী অলৌকিক কারবার! কাকড়াজানের ঢনঢনিয়া মুচারিয়া চালার একটি ঘরও অক্ষত নেই। ঘরের ঢেউটিন সব সমান হয়ে গেছে। কোনো গাছে ডালপালা নেই, ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। তৈলধরার শত শত বাড়ির টিন চালুনছিদ্র হয়ে গেছে। আমি প্রায় চল্লিশ ঘণ্টা পর দুর্গত এলাকায় গিয়েছিলাম। সে সময়ও বরফ গলা শেষ হয়নি। অনেকে বলেছে, ঝড়ের ত্রিশ ঘণ্টা পরও ছয়-সাত কেজি ওজনের বরফ খণ্ড পাওয়া গেছে। ত্রিশ ঘণ্টা পর যদি ছয়-সাত কেজি ওজনের বরফ খণ্ড পাওয়া যায়, তাহলে যখন সেটা পড়েছিল তখন তার ওজন কতটা ছিল, কোনোমতেই ১৫-২০ কেজির কম হবে না। এত ভারী বস্তু আকাশ থেকে পড়লে ঘরের যা অবস্থা হওয়ার তাই হয়েছে। কোনো গাছের ডালপালা নেই, ক্ষেতের ধান নেই। ওই এলাকায় কোনো মানুষের এক ছটাক ধান পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সরকার এত বড় বড় কথা বলে, কিন্তু কোনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি।

কোনো মন্ত্রী-এমপি বা কোনো বড়সড় নেতা দুর্গত এলাকায় যায়নি। বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। বিজয়ের পর এই সাড়ে তিন বছর শুধু নাচানাচি, কনসার্টে মানুষের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। মানুষজন বলছে, আল্লাহর নাম নেই শুধু সার্কাস, জুয়া, হাউজি, উলঙ্গ নাচ। এত বড় বিপর্যয় ও দুর্যোগ হলো, কিন্তু ত্রাণমন্ত্রী আমার এলাকার মানুষ। এক মুহূর্তের জন্যও দুর্গত এলাকায় যাননি। এক ভয়াবহ দুর্বিষহ অবস্থা সেখানে। এখন কী যে হবে দুর্গত এলাকার মানুষের, আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনই জানেন। আমি যখন করটিয়া কলেজে পড়তাম তখন জমিদার পন্নীদের বলতে শুনেছি, ৬০-৭০ বছর আগে তাদের বাপ-চাচারা যখন হাতি চড়ে পাহাড় এলাকায় যেতেন, সখিপুরের পশ্চিমে মাজারপার হজরত শাহ কামালের মাজারের কাছে গেলে হাতি বসে পড়ত। কোনো সওয়ারী নিয়ে ওই এলাকা পার হতে চাইত না। পাশেই ওলিয়ে কামেল হজরত শাহ কামালের মাজার।

হাতি সওয়ারী নিয়ে যেতে চায় না—এটা জানাজানি হওয়ার পর আর কখনও করটিয়ার জমিদাররা হাতিতে বসে ওই এলাকা পার হতেন না। নেমে পায়ে হেঁটে পার হতেন। সেই মাজারের পাশে গত তিন মাস সার্কাস হয়েছে, জুয়া হয়েছে, হাউজি হয়েছে, মেয়েদের অশ্লীল নৃত্য হয়েছে। আমি স্থানীয় সংসদ সদস্যকে ওসব না করতে কয়েকবার বলেছি। এরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে আমার সহকর্মী ছিল। কিন্তু এখন যারা আওয়ামী লীগ করে, তারা কেউ কারও কথা শোনে না। সখিপুরের দাড়িয়াপুর ফালুচান্দের এক জাগ্রত মাজার।

সেখানে নানাভাবে পাগলদের হয়রানি করা হয়েছে। বাসাইলের বার্থার নব্বেছ চান্দের মাজারে লাখো মানুষের সমাগম হয়। সেখানে কত কী যে করা হয়েছে। বেয়াদবির সীমা-পরিসীমা নেই। মহানন্দপুর হিন্দু পল্লীতে যেখানে কয়েক হাজার গাছের এক আম বাগানে একটি গাছও অক্ষত নেই, দেখে মর্মাহত হয়েছিলাম। সেখানে বয়সী মুরব্বিরা বড় তীর্যকভাবে বলছিলেন—‘এত জুয়া, হাউজি, সার্কাস আর গান-বাজনা করলে আল্লাহ সেখানে গজব না ফেলে কি রহমত দিতে পারেন?’ মুরব্বিদের কথা শুনে বড় বেশি বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। তবে কি ক্ষমতাসীনদের পাপের শাস্তি আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন দরিদ্র গরিব জনসাধারণকে দেবেন? লাল বানু নামে ১২০-১২৫ বছরের এক বৃদ্ধা আমায় তার ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বেশ কয়েকবার আমায় খাইয়েছিলেন। তার ঘরের একটি টিনও অক্ষত নেই। বড় বড় শিল পড়ে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। তিনি তার ভাঙা চৌকিতে বসিয়ে একটি জাজিম দেখিয়ে বললেন, ‘বাবা, ঘরে ওই জাজিমটা ছিল বলে ওর নিচে গিয়ে শিলের আঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছি।’ দুর্গত এলাকার মানুষদের দয়া করে আল্লাহ তো জীবন বাঁচিয়েছেন, কিন্তু দয়াময় আল্লাহর দয়া না হলে বর্তমান উদাসীন সরকারের জমানায় তাদের জীবন বাঁচবে কি করে? দয়াময় তুমি আমার মানুষদের বাঁচাও।

যে উত্সাহ নিয়ে শান্তিময় বাংলা বছরের আশা করেছিলাম তা শুরুতেই কেমন যেন ফিকে হয়ে গেল। একেবারে হতাশ না হলেও কিছুটা শঙ্কাবোধ তো করছিই। একবুক জ্বালা নিয়ে ২৪ এপ্রিল ১৮ দলীয় জোটের প্রধান শরিক জাতীয়তাবাদী দলের পল্টনের কার্যালয় গিয়েছিলাম। তাদের কাছে যা প্রত্যাশা করেছি, তার চেয়ে কম সৌজন্য পাইনি। চারদিকে পুলিশ আর পুলিশ। তারা ছিল খুবই উদ্বিগ্ন। বাড়ির মালিক ভালো না হলে তার কর্মকর্তা-কর্মচারী ভালো হবে কী করে? সরকারের সৌজন্য নেই, সহনশীলতা নেই, কাউকে ন্যূনতম সম্মান দেখানোর কোনো তাগিদ নেই। সেখানে পুলিশরা তো একটা লাঠিয়াল বাহিনী। তারা কিইবা করতে পারে। চারদিক থেকে তাদের ওপর যে পরিমাণ চাপ, অথচ মানবিক গুণাবলীর কিছুই শিক্ষা দেয়া হয়নি। তার পরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের যে আচরণ দেখি, তাতে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। সেদিনও যে তেমনটি দেখিনি তা নয়। গামছা বিছিয়ে তপ্ত রোদে পল্টনের রাজপথে পড়ে ছিলাম। পল্টন থানার ওসি ও উপ-কমিশনার যথার্থই উপযুক্ত কর্মকর্তার মতন পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। আইনানুগ যতটুকু করা দরকার তা তারা করেছেন। সারাদিন তপ্ত রোদে পুড়ে নিম্নস্থ পুলিশ কর্মচারীরা কীভাবে ধৈর্য রাখে, সেটাই তো প্রায় ৫০-৫৫ মিনিট নিচে-উপরে আগুন নিয়ে পিচঢালা রাজপথে শুয়ে থেকে পিঠে ১০-১৫টি ফোসকা ফেলে নিজেই দেখেছি। তাই সবকিছু একতরফাভাবে বলে কোনো লাভ নেই। আমাদের কর্মচারীদের চাইতে কর্মকর্তাদের উদাসীনতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা বেশি। নেতারা ভালো হলে, সরকার ভালো হলে কর্মকর্তারা অবশ্যই ভালো হতো। ভালো কর্মকর্তা থাকলে দেশের জন্য আমরা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কর্মচারী পেতাম। দুর্ভাগ্য, আমরা তেমন পাইনি। বিএনপি অফিসে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে আমরা যথাযথ রাজনৈতিক আচরণই পেয়েছি। জনাব রুহুল কবীর রিজভীর আচরণও ছিল যথার্থ। আন্দোলনরত প্রধান বিরোধী দলের অফিসে গিয়ে সরকার দ্বারা নির্যাতিত হয়েছি। কাঠফাটা রোদে পল্টনের রাজপথে নেতাকর্মীসহ সস্ত্রীক পড়ে থেকে কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্ত করে বাড়ি ফিরেছি। ওইদিনই প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন ছিল। সৌজন্যের খাতিরে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং তার প্রতি সরকারি জুলুম সম্পর্কে কেন যেন একটি কথাও বলেননি। এই একবারও কিছু না বলায় সাধারণ মানুষ যেমন, আমাদের দলীয় নেতাকর্মীরাও কমবেশি আহত হয়েছে। দেশে রাজনৈতিক দল থাকে অনেক। সংগ্রামের ধারা সব সময় দুটি। একটি সরকারি, আরেকটি বিরোধী। সরকার সরকারের মতো না চললে সরকারের কানে পানি দেয়ার জন্য বিরোধী দলের ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচি থাকলেও মূল লক্ষ্য এক। তা হলো সরকারকে সরকারের মতো চালানো, সেক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দল এবং দলনেতার সার্বিক নেতৃত্বই দেশবাসী আশা করে।

২৪ এপ্রিল জাতীয়তাবাদী দলের কার্যালয়ে যাওয়ার পথে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতাকর্মীদের ওভাবে গ্রেফতার করা সভ্য সমাজের বিচারে জঘন্য নিন্দনীয় কাজ। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতা ফরিদ আহমেদ, আলমগীর হোসেন, রিপন, আতাউল গনি ওসমানী, আরিফ, কাইয়ুমসহ আরও অনেককে গ্রেফতার করে পল্টন থানার কয়েদখানায় নিয়ে রাখা মোটেই ভালো হয়নি। বিষয়টা সবাইকে খুবই হতাশ এবং মর্মাহত করেছে। দলীয়ভাবে আলোচনা করে একটা বৈঠকে যাওয়ার পর কিছু নেতাকর্মীকে পুলিশের কয়েদখানায় রেখে বাড়ি ফিরতে মন খুব একটা সায় দেয়নি। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংগ্রাম করতে চেয়েছি। তাই রাস্তায় শুয়েছিলাম। জনাব গোলাম আজমের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করিনি। আমি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তাই অত কাঠফাটা রোদে প্রকাশ্য দিবালোকে সহধর্মিণী নাসরীন সিদ্দিকীকে পাশে রেখে শুয়ে ছিলাম। সেদিন নতুন করে উপলব্ধি করেছি বিপ্লবী কবি কাজী নজরুলের কথা, ‘কোনদিন একা হয়নি তো জয়ী পুরুষের তরবারী, প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী নারী।’ সত্যি পুরুষের পাশে আন্তরিকভাবে কোনো নারী দাঁড়ালে তাকে রোধ করার কোনো শক্তি কারও থাকে না। অতীতে ছিল না, ভবিষ্যতেও হবে না। সেজন্য নাসরীন সিদ্দিকীকে ধন্যবাদ, গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই। আমরা মারামারি, কাটাকাটি করতে যাইনি, গাড়িতে আগুন দিয়ে নিরীহ চালককে পুড়িয়ে মারতে যাইনি। সে সময়ের জন্য আমাদের বিচার-বিবেচনায় যা সবচাইতে বেশি কার্যকরী ও উপযুক্ত মনে হয়েছে, তা-ই করেছি। আমার মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক রাজধানীর রাজপথে পড়ে থাকলে যদি দেশ ও জাতির সম্মান বৃদ্ধি হয় তাহলে তা হয়েছে। আর যদি ওইভাবে রাস্তায় পড়ে থাকার কারণ ঘটানোর কাজ করে অন্যায় করে থাকে সরকার ও প্রশাসন এ থেকে সাবধান থাকবে, সেটাই বিবেকবান মানুষ মনে করে। দেশ ও দেশের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক ও সাধারণ মানুষের জন্য শঙ্কাময় হোক, এটা আমরা চাই না। এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা বা স্বাভাবিক করা সরকারের দায়িত্ব। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার ঘটনা কোনোমতেই কারও জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়। গুম কে করেছে—সরকার না বিরোধী দল, এটা আমাদের কোনো বিবেচ্য নয়। ইলিয়াস আলী গুম হয়েছে, তাকে পাওয়া যাচ্ছে না জনসমক্ষে তাকে হাজির করা সরকারের দায়িত্ব, সেটা করতে হবে। যত মোচড়ামুচড়ি করা হোক, এখান থেকে পরিত্রাণের সরকারের কোনো উপায় নেই। ইলিয়াস আলী কী ধরনের লোক ছিল, এগুলো কোনো কৈফিয়তের মধ্যে পড়ে না। সে এদেশের নাগরিক, মানুষ তার খবর চায়। তার পরিবার-পরিজন শঙ্কিত ও ব্যথিত। আমরাও সমভাবে ব্যথিত। তাই আমরাও তাকে চাই। ইদানীং সরকারি দলের যেসব নেতা কথায় কথায় যুদ্ধ করতে চান, যুদ্ধের সময় তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে না—এটা ষোল আনা নিশ্চিত। এরা সবাই ফাঁকা মাঠে গোল দেয়া খেলোয়াড়। একজন আরেকজনকে দোষারোপ করে বাগাড়ম্বর করার কোনো মানেই হয় না। তাই ইলিয়াস আলীর ঘটনা সমাধান করতে হবে। প্রধান বিরোধী দলকেও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সংগ্রাম করতে হবে। জনগণকে দুঃখ-দুর্দশায় ফেলে শুধু শুধু হরতাল দিয়ে কেউ কোনো আন্দোলন সফল করতে পারেনি। তেমন আন্দোলনের চেষ্টা করলে সেটা ফলপ্রসূ, সফল হবে না। সেজন্য বিরোধী দলের নীতিনির্ধারকদের অনুরোধ জানাব, জনগণের সুবিধা-অসুবিধা, ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে অবমূল্যায়ন করবেন না। উত্তপ্ত অবস্থায় আপনাদের কার্যালয়ে গিয়ে সরকারের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছি। তারপরও দেশের স্বার্থে আন্দোলনের ভবিষ্যত্ নিয়ে আপনাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই। উদ্ভূত পরিস্থিতির অবসানে সরকার, মহাজোট ও তার প্রধান নিয়ন্ত্রক আওয়ামী লীগের সঙ্গে কথা বলতে আমরা উত্সাহ প্রকাশ করছি। ২৫ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে চিঠি দিয়েছি, টেলিফোনে আলাপ করেছি। আশা করি নিশ্চয়ই সরকার এবং সরকারি দলের দেশের এই নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলার সময় সুযোগ হবে। বিরোধী দলের আবার হরতাল আহ্বানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনি এটা কী বলেছেন? আপনি তো পুলিশের মন্ত্রী।

আপনি তো পুলিশকে যা বলার বলবেন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আপনি বলার কে? আপনি কি আওয়ামী লীগ সভাপতি? নাকি সাধারণ সম্পাদক? নাকি অন্য কিছু? যার যে কাজ, সে কাজ করুন। অন্যের সীমানায় পা দেয়া ভালো নয়। আপনাকে পুলিশের মন্ত্রী বানিয়েছে, পুলিশ নিয়ে থাকুন। আওয়ামী লীগ কর্মী নিয়ে টানাটানি করছেন কেন? আর সবাই না জানলেও আমরা তো জানি, যারা সভানেত্রীর কথা ভালোভাবে মানে না-শোনে না তারা আপনার কতটা কী শুনবে? তাই ওসব না বলে দেশকে বাঁচান। বাতাসের কান্না কান পেতে শুনুন। রেল মন্ত্রণালয়ের ঘুষ-দুর্নীতি আড়াল করতে ইলিয়াস আলীকে গুম, ইলিয়াস আলীর ঘটনার উত্তাপ প্রশমন করতে আবার অন্য কোনো ঘটনা—এসব জাতির কাম্য নয়। মানুষ শান্তি ও স্বস্তিতে থাকতে চায়। তেত্রিশ মাসেও সোহেল তাজের পদত্যাগ গ্রহণ করা হয়নি। সরকারি তহবিল তছরুপ করে তার অ্যাকাউন্টে মন্ত্রীর বেতন-ভাতা দেয়া হয়েছে। এটা এক জঘন্য দুর্নীতি। ব্যক্তিগত স্বাক্ষর ছাড়া এক মাসের বেতন-ভাতাও কাউকে দেয়া যায় না। তাহলে এই অনিয়ম কী করে সম্ভব? দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে যখন সোহেল তাজ সংসদ সদস্যপদে ইস্তেফা দিয়েছে, তখন সেটা গ্রহণেও গড়িমসি চলছে, এটা ভালো কথা নয়। পণ্ডিতি করে লাভ কী? কত শত অনিয়ম হচ্ছে, অশুদ্ধ কাজ হচ্ছে। সোহেল তাজের পদত্যাগপত্র তার ইচ্ছে অনুসারে গ্রহণ করলে আর কত কী ক্ষতি হবে? মাননীয় স্পিকার ওটা গ্রহণ করে ফেলুন। মোচড়ামুচড়ি করে লাভ নেই। বাপের বেটা বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমেদের পুত্র সোহেল তাজ, তারা থুথু ফেলে থুথু চাটার বংশ নয়। সংসদের কার্যপ্রণালীর ১৭৭ বিধির (১) এ বলা হয়েছে, ‘সংসদের আসন হইতে পদত্যাগ করিতে ইচ্ছুক কোনো সদস্য এই মর্মে স্পিকারকে সম্বোধন করিয়া স্বহস্তে লিখিতভাবে জ্ঞাপন করিবেন যে, তিনি তাহার আসন হইতে পদত্যাগ করিতে ইচ্ছুক।’ মাননীয় সংসদ সদস্য সোহেল তাজ স্বহস্তে স্বাক্ষর করেছেন। পুরো লেখাটি তিনি স্বহস্তে লেখেননি, এই অজুহাতে ক’দিন তার পদত্যাগপত্র ঠেকিয়ে রাখা যাবে। লাউয়ের নাম যেমন কদু, ঘাড়ের নাম গর্দান—ঠিক তেমনি যতটুকু লেখাপড়া জানলে স্বহস্তে উপরের কথাগুলো লেখা যায় ততটুকু লেখাপড়া এবং সত্ সাহস মনে হয় সোহেল তাজের আছে। এটা সবার ভালো করেই জানা। লেবু বেশি চিপলে তেতো হয়। সোহেল তাজের ব্যাপার নিয়ে বেশি চাপাচাপি করলে তেতোর চাইতে ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে। তাই অত মুরব্বিপনা না করে সময় থাকতে সাবধান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। না হলে পরিণতি আরও ভয়াবহ হবে।

পূর্বের অংশ

সোমবার ২৩ এপ্রিল ২০১২

রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ ও ইলিয়াস আলী গুম
-বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম

তারছেঁড়া বীণার মতো সব যেন কেন বেসুরা ঠেকছে। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস ভালোভাবে পালন করা হলো না, কোনো জাতীয় পত্রিকায় তেমন স্থান পেল না। এরপর মুক্তিযুদ্ধ স্থান পাবে না, তারপর স্বাধীনতা। আর একটু পর হয়তো কারও সঙ্গে গাঁটছড়া, তাহলেই সব শেষ। গাড়ির চালকসহ ইলিয়াস আলী গুম। রেলমন্ত্রীর পদত্যাগের পর আবার দায়িত্বহীন অবৈধ মন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের গুলে টোকা মেরে নিজের এবং দেশের এমন সর্বনাশ করলেন, যা দেখে লিখতে তেমন অন্তরের তাগিদ পাই না।

গত ১৬ এপ্রিল সোমবার লিখেছিলাম ‘মাননীয় রেলমন্ত্রী, সময় থাকতে পদত্যাগ করুন’। বর্ষীয়ান জননেতা পদত্যাগ করে কিছুটা হালকাও হয়েছিলেন। কারণ এ উপমহাদেশে আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে রাজনৈতিক নেতাদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগের খুব একটা নজির নেই। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় এমন অনেকে আছেন, যাদের বেত মেরেও সরানো যাবে না। যা বললে বাড়ির কাজের বুয়ারা কাজ ছেড়ে চলে যাবে, তার চেয়ে শত গুণ বেশি বলার পরও মন্ত্রিসভা আঁকড়ে আছেন অনেকে। এখন সম্মানের চেয়ে পদের মোহ বেশি। আর এজন্য পদলোভীদের দোষ দেয়াও যায় না। গাছ আর পরগাছার মধ্যে এখানেই পার্থক্য। গাছ সব সময় নিজের কাণ্ডের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পরগাছা তা পারে না। সব সময় তাকে অন্যের সাহায্য নিতে হয়। দু-একটা পরগাছা মাটি থেকে একটু-আকটু উপরে উঠলেও কাউকে জড়িয়েই উঠতে হয়। নিজের মুরোদে দু-চার-দশ ইঞ্চিও উঠতে পারে না। রাজনীতিতেও নেতা আর পাতিনেতা, রাজনৈতিক কর্মী আর কর্মচারী এক নয়। এখন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মীর বড় অভাব। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা যারপরনাই অবহেলিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিন্দিতও। পতিতার মতো ভ্রষ্টাদেরই এখন জয়জয়কার। পতিতাদের ভ্রষ্টা বললেও তাদের প্রতি অমর্যাদা করা হয়। তাদেরও নীতি আছে, আদর্শ আছে। তারা কেউ চুরি, ডাকাতি, খুন-খারাবি করেনি। সমাজের বঞ্চনা, অবিচার ও বৈষম্যের শিকার হয়ে যারা পতিতা হয়, তাদের চেয়ে ভ্রষ্ট রাজনৈতিক পতিতারা হাজার গুণ নিকৃষ্ট। আমি সাবেক রেলমন্ত্রী শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগ এবং ঠিকানাহীন মন্ত্রী থাকার বিষয় নিয়ে আলোকপাত করছি।

বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, এটা প্রায় সবারই জানা। দুর্নীতির কথা শুনলে আগে মনটা বড় বিষিয়ে উঠত। এখন শুনতে শুনতে গা-সওয়া হয়ে গেছে। আগে নীতিবান মানুষরা অন্যকে অন্যায়ভাবে মিথ্যা অপবাদ দিত না। এখন স্বার্থের কারণে অনেকেই যা ইচ্ছা তাই বলতে পারে। ক’দিন আগে তার উজ্জ্বল প্রমাণ পেয়েছি ধনকুবের আশিকুর রহমানের কাছ থেকে। পাকিস্তান হানাদারদের তস্য দালাল মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইল ন্যাশনাল ব্যাংকের পাঁচ-ছয় কোটি টাকা চুরি করেছিল। সেই মানুষ এই সেদিন ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে ব্যাংকের মালিক হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা হলাম বঞ্চিত। হানাদার পাকিস্তানের সেবাদাস হয়ে আশিকুর রহমানের মতোরা হলো পুরষ্কৃত। শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মাথা থেকে পা পর্যন্ত একজন রাজনৈতিক মানুষ। একজন রাজনৈতিক মানুষের দোষ-গুণ যা থাকে, কমবেশি তারও তা আছে। তিনি একেবারে রাস্তার ফেলনা মানুষ নন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দু-চার-দশজনের পরই তালিকায় তার নাম আসবে। প্রায় পঞ্চাশ বছর রাজনীতি করে তিনি মাত্র সাড়ে চার-পাঁচ মাস মন্ত্রিত্ব করে ঘুষ কেলেঙ্কারির দায় মাথায় নিয়ে ১৬ এপ্রিল দুপুরে পদত্যাগ করেছিলেন। তার এপিএস ওমর ফারুক মাত্র ৭০ লাখ টাকা নিয়ে রাতে ঘোরাফেরা করছিল। সঙ্গে ছিল একজন জেনারেল ম্যানেজার এবং পাহারাদার হিসেবে রেল কমান্ড্যান্ট। গভীর রাতে বিজিবি গেটের ঘটনা। হুড়মুড় করে গাড়ি গিয়ে বিজিবি ক্যাম্পে ঢুকল। ড্রাইভার চিত্কার করল, গাড়িতে অনেক অবৈধ টাকা আছে। সেখানে তাদের আটকে রাখা হলো, সকালে ছেড়ে দিল। কেন আটকাল, কেন ছাড়ল—সবই রহস্যাবৃত। প্রথমে বলা হলো টাকা নিয়ে মন্ত্রীর বাড়ি যাচ্ছিল। মন্ত্রী ওই সময় দশ বার ফোন করেছেন। এমনকি কোনো এক সময় তিনি বিজিবি হেডকোয়ার্টার্সেও গিয়েছিলেন, জিনিসগুলো কেমন যেন ঘোলাটে ঠেকছে।

দেশবাসীর নিশ্চয়ই মনে আছে, বিক্রমপুরের আড়িয়ল বিলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমাবন্দরের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে যখন আন্দোলন চলছিল তখন বিএনপির কোনো নেতা সেখানকার কোনো লোকের সঙ্গে মোবাইলে কী কথা বলেছেন, মাঝেমধ্যেই দেশবাসীকে তা শোনানো হচ্ছিল। এখন তো প্রযুক্তির আরও উন্নতি হয়েছে। প্রায় দশ দিন যায়, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সেই রাতে ঘুষের টাকার জন্যে দশ বার কথা বললে তার কণ্ঠ বা মোবাইল আলাপ এ ক’দিনে হাজার বার শোনানো হতো। কিন্তু এত দিনে একবারও শুনলাম না। তবে কি তিনি নির্দোষ? এসব লুটপাটের সঙ্গে বা কালো বিড়ালের সঙ্গে তার কোনো সংশ্রব নেই? বা যদি সত্যই সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, এর সঙ্গে লেশমাত্র তার সংশ্রব নেই, তাহলে তিনি যে পূত-পবিত্র হয়ে রাজনীতিতে ফিরে আসতেন, তার সব পথ পদত্যাগের পরপরই আবার খামাখা, মানে দায়িত্বহীন মন্ত্রী বানিয়ে বন্ধ করে দেয়া হলো। পদত্যাগ করে জনমনে যে বিশ্বাসের সঞ্চার করেছিলেন, দফতরবিহীন ঠিকানাহীন খামাখা মন্ত্রী হয়ে ষোলো আনার স্থলে আঠারো আনা দোষের ভাগী হলেন। সেনগুপ্ত যেমন পদত্যাগ করতে পারেন, প্রধানমন্ত্রী একজন জেদি মানুষ হিসেবে তাকে আবার মন্ত্রী বানাতে পারেন। কারণ মন্ত্রী বানানোর কারখানার মালিক তিনি। কিন্তু তবু কিছু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা না মেনে উপায় নেই। আপনি যখন পতাকাহীন গাড়িতে বাড়ি ফিরেছেন, তখনই আপনার আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রীর শপথ এবং মন্ত্রগুপ্তি ভঙ্গ হয়ে গেছে। তাই দায়িত্বহীন ঠিকানাহীন মন্ত্রী হলেও আপনাকে আবার শপথ নিতে হবে, না হলে কোনো মতেই মন্ত্রী নন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা খুশি তা-ই করতে পারেন। কিন্তু আপনি তো সংবিধানের সব পাতা উল্টেছেন, কোথায় কী লেখা আছে তা তো আপনার না জানার কথা নয়। তাহলে এক শপথে দু’বার মন্ত্রী থাকেন কী করে? আপনি পদত্যাগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী আপনাকে আবার নিশ্চয় মন্ত্রী বানাতে পারেন। কিন্তু পদত্যাগ করার পর একই শপথে মন্ত্রী রাখতে পারেন না। আপনি পদত্যাগপত্র কি প্রত্যাহার করেছেন? তা না করে ওই পদত্যাগপত্র ব্যাগে রেখে যা খুশি তাই করা যাবে না। কোনো মন্ত্রী পদত্যাগপত্র লেখার সঙ্গে সঙ্গেই তার পদ শূন্য হয়ে যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হুট করে বলে দিলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে যেহেতু পদত্যাগপত্র পাঠানো হয়নি, তাই তিনি মন্ত্রী আছেন। এটা কোনো কথা হয় নাকি? কেউ কাজ করবেন না, তার মন্ত্রী থাকার ইচ্ছে নেই—তারপরও জোর করেই তাকে রাখবেন, এটা কেমন করে হয়?

সোহেল তাজের বাপ-চাচা দু’জনকেই মন্ত্রিসভা থেকে সরানো হয়েছিল—একজন বঙ্গবন্ধুর সময়, আর একজন গতবার বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সময়। তবে কি জোর করে রেখে অতীতের ভুল বা খামখেয়ালির কাফ্ফারা দিতে চান? তা করারও তো একটা রীতিনীতি বিধিবিধান আছে। গায়ের জোরে তো তা করা যায় না। তদন্তে বা বিচারে এখন শতভাগ নির্দোষ প্রমাণিত হলেও মানুষ মনে করবে মন্ত্রিত্বের প্রভাব খাটিয়েছেন বা প্রভাব খেটেছে। রেলওয়ের বর্তমান মহাপরিচালক খুব একটা করিত্কর্মা বলে কখনও সুনাম অর্জন করতে পারেননি। ভদ্রলোক বলেছেন, যদি দরকার পড়ে বা প্রয়োজন হয় মন্ত্রী মহোদয়কেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তার মানেটা কী দাঁড়ায়? মানে হলো কেউ কিছু নয়, সবাই নাকের পশম। প্রধানমন্ত্রী নিরাপদে থাকলেই হলো। মন্ত্রীদের কেরানিরাও জিজ্ঞেস করতে পারে। আর জবানি তো একটা আছেই—আইনের চোখে সবাই সমান। চরম দুর্ভাগ্য রাজনীতিবিদদের। রাজনীতিকরা কেউ বিপদে পড়লে একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়ায় না, বরং আরও বিপদে ফেলতে চেষ্টা করে। কিন্তু আমলারা বিপদে পড়লে সত্য-মিথ্যা যেভাবেই হোদের তাকে বাঁচানোর জন্যে সবাই কোমরে গামছা বেঁধে নামে। এক্ষেত্রেও তেমন হবে। এর মধ্যেই কেউ কেউ বলছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ষড়যন্ত্রের শিকার। যদি তাই হয় তাহলে অবৈধ দফতরবিহীন মন্ত্রী থেকে মারাত্মক ভুল করেছেন। পদত্যাগ তাকে যে রাজনৈতিক উচ্চতায় নিয়ে যেত প্রধানমন্ত্রী তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করে রাজনৈতিক নৈতিকতার একেবারে নিচু পর্যায়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে কীইবা বলতে পারি!

এ পৃথিবীতে যত গুণবতী রূপবতী নারীই হোন, সন্তান না হলে তাকে বন্ধ্যা বলে। মহারানী ভিক্টোরিয়া অথবা এলিজাবেথের ক্ষেত্রেও এ উদাহরণ খাটে। পৃথিবীতে স্বাভাবিকভাবে ভিন্ন প্রক্রিয়ায় সন্তান ধারণের কোনো উপায় নেই। শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার এপিএসের ঘুষের কেলেঙ্কারির খবর শোনামাত্র যদি এইসব কালো বিড়ালের সঙ্গে কাজ করা যায় না বলে ধিক্কার দিয়ে পদত্যাগ করতেন তাহলে এমন হতো যে—একজন বিবাহিত নারী প্রথম সন্তানসম্ভবা হলে তার শ্বশুর-শাশুড়ি, আত্মীয়-স্বজনের যে রকম গর্ব হয়, পাড়া-প্রতিবেশীদের মিষ্টি খাওয়ায়, রাজনীতির জন্য তেমন আনন্দের হতো। দেরিতে পদত্যাগ করা এবং এক দিন পর নাম-গোত্রহীন অবৈধ মন্ত্রী পদ গ্রহণ করায় এমন হয়েছে যে, কোনো সামাজিক স্বীকৃতিহীন নারী সন্তানসম্ভবা হলে যেমন মুখ লুকোবার কোনো জায়গা পায় না, সারা পৃথিবীর আলো তার কাছে অন্ধকার হয়ে যায়, ঠিক তেমনই হয়েছে। রেল মন্ত্রণালয়ে সাত হাজার চাকরির জন্যে দু-একশ কোটির ঘুষ আদান-প্রদান যে হয়েছে, সে কথা তো মোটেই মিথ্যা নয়। সেখানে ৭০ লাখ তো কিছুই নয়। অনেকে তো এও বলাবলি করছে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের চাপে তাকে মন্ত্রী রাখা হয়েছে। হতেও পারে। আবার এও হতে পারে, প্রধানমন্ত্রী তাকে থলিতে ভরে রাখতেই এমনটা করেছেন। কোনটা সত্য, তা ভবিতব্যই জানে।

সেদিন সেনগুপ্তের এক প্রতিদ্বন্দ্বী বলেছেন, ছেলেবেলায় লেখাপড়ার খরচ জোটাতেও নাকি তার মা-বাবার কষ্ট হয়েছে। তাতে দোষের কী হয়েছে? দু-চার-পাঁচ বছর আগেও যারা ভাঙা কাপে চা খেতেন, ছেঁড়া স্যান্ডেল পায়ে ঘুরতেন, মালোয়েশিয়ার হোটেলে অন্যের রুমে মেঝেতে পড়ে থাকতেন, তারা যদি শত শত হাজার কোটি টাকার মালিক হতে পারেন, তাহলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এতদিন রাজনীতি করলেন, তার ছেলে লেখাপড়া করে চাকরি-বাকরি করে মাত্র পাঁচ কোটি টাকার একটি টেলিকম লাইসেন্স নিয়েছে তাতে কী হয়েছে? নগদ টাকা দিয়েছে, নাকি ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়েছে, কিছুই পরিষ্কার নয়।

রাজনীতি করে বলে কি ভিক্ষে করে খেতে হবে? আগেও রাজনীতিবিদরা ফকির ছিলেন না। সেদিন দুপুরে একজনের সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলাম, ’৬৮ সালে বাবা এবং বড় ভাই জেলে থাকায় টাঙ্গাইলে এক সভা করতে গিয়ে জননেতা আবদুল মান্নান বাসার খরচ চালাতে মাকে দেয়ার জন্যে আমার হাতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবিওয়ালা একশ’ টাকার কড়কড়ে পাঁচটা নোট দিয়েছিলেন। যখন এক-দেড়শ’ টাকায় গ্রামেগঞ্জে এক পাখি জমি কেনা যেত। টাঙ্গাইল শহরেও একশ’ টাকায় পাঁচ-সাত ডেসিমল জায়গা পাওয়া যেত। দিঘুলিয়া, কাগমারী, দেওলা, কোদালিয়া, ধুলেরচরে তখনও দুইশ’ টাকায় এক পাখি জমি পাওয়া যেত। যে জমির দাম এখন দেড়-দুই কোটি টাকা। তাই রাজনীতি করলেই তাকে ফকিন্নি ভাবা উচিত না। রাজনীতিবিদদেরও মান-মর্যাদা থাকতে পারে। শুধু রাজনীতিবিদরা দুর্নীতি করে, আমলারা করে না, ব্যবসায়ীরা করে না? উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, জজ, ব্যারিস্টার, দারোগা, পুলিশ সবাই সত্। অসত্ শুধু রাজনীতিবিদ। এ ধারণার অবসান হওয়া উচিত। অযোগ্য অসত্ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে রাজনীতি পড়ে প্রকৃত রাজনীতির বারোটা বেজেছে। তাই এসব কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। এখন সময় এসেছে এসবের একটা ফয়সালা হওয়ার।

স্বাধীনতার মূল মন্ত্রই হলো নাগরিকের জানমালের হেফাজত, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নামে দেশে এসব কী হচ্ছে? প্রতিপক্ষকে গুম করার কৌশল ছিল পাকিস্তানের। আমরা তাদের উপনিবেশ ছিলাম। তারা আওয়ামী লীগের জন্মদাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হককে গুম করেছিল। তাই বলে এই একবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গবন্ধুর মেয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান থাকা অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক নেতাকর্মী গুম হবে, এটা আশা করা যায় না। আর গুম হয়ে কেউ যদি জীবন হারায় তাহলে তার যা ক্ষতি হবে, তার পরিবারের যে ক্ষতি হবে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হবে আওয়ামী লীগের, আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার এবং তার সরকারের। গুমের রাজনীতি করে পাকিস্তান রক্ষা পায়নি। ইরানের বাদশাহ রেজা শাহ পাহলভী পাননি। ইলিয়াস আলী বিরোধীদলীয় রাজনীতি করেন বলে হারিয়ে যাবেন কেন? গণতান্ত্রিক সরকারে, গণতান্ত্রিক দেশে, গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে দেশের একটা কাকপক্ষী মারা গেলেও তার দায়ভার সরকারের ওপর বর্তায়। আর প্রধানমন্ত্রী ঘাতকের হাতে বাপ, চাচা, মা, ভাই, ভাবী হারিয়েছেন। স্বজনহারা কলিজাছেঁড়া যন্ত্রণা প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে অন্যের বেশি বোঝার কথা নয়। তাহলে তার শাসনামলে অমন হবে কেন? কোথায় দুর্বলতা? তাহলে কি রাষ্ট্রযন্ত্র তার নিয়ন্ত্রণে নেই? মানবিক গুণাবলি সব কোথায় গেল?

একটা রাষ্ট্র কারও কোনো খামখেয়ালির ওপর চলে না, চলতে পারে না। এটা তো জনগণের রাষ্ট্র। জনগণের শাসন ব্যবস্থা। রাজা-বাদশাহদের আমলেও কারও সম্পূর্ণ খেয়াল-খুশিমত রাষ্ট্রযন্ত্র চলেনি। নেশায় আসক্ত মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন নুরজাহানের প্রেমে বিভোর, তার রূপগুণে বন্দি। জাহাঙ্গীরের আমলে মূলত মোগল সাম্রাজ্যের প্রায় সব কলকাঠিই নাড়াতেন সম্রাজ্ঞী নুরজাহান। তারপরও সেখানে রাষ্ট্র পরিচালনার কিছু নিয়মকানুন, নীতি-আদর্শ ছিল। আসফ খাঁর মেয়ে ইরানি সুন্দরী নুরজাহানের জন্য পাগল সম্রাটও তার বিচার করার সময় কোনোরকম দ্বিধান্বিত হননি। এ ঘটনা আমরা নিম্নশ্রেণীতে প্রায় সবাই পড়েছি—শিকারের সময় নুরজাহানের ছোড়া তীরে দূরে কোথাও এক দুখিনীর সন্তান মারা গিয়েছিল। মোগল সাম্রাজ্যে যদি অমন হতে পারে, তাহলে এখন গণতন্ত্রের যুগে কেন হবে না? বিরোধী রাজনীতি করে বলে কেউ গুম হবে, হারিয়ে যাবে আর পাওয়া যাবে না—এ তো গণতন্ত্রের জন্যে অশনি সঙ্কেত। ইলিয়াসের মতো অমন একজন রাজনৈতিক নেতা গুম হলে সাধারণ আটপৌরে মানুষের অবস্থা কী? সবাই শঙ্কিত। মানুষকে শঙ্কামুক্ত রাখা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রথম এবং প্রধান উপাদান।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অনেক সময় অনেক কথাই আপনি বলেন। কোনো কোনো কথায় মানুষ ভীষণ কষ্টও পায়। তবু তাদের কিছু করার থাকে না। হাজার হলেও আপনি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে। ইলিয়াস আলীর ব্যাপারে কি এই সময় ওইভাবে কথাটি না বললেই হতো না? আপনার বাবা শত্রুর জন্যও কাঁদতেন। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে বন্দি বাঙালিদের জন্যে তার সে কী নিদারুণ উত্কণ্ঠা দেখেছি। স্বাধীন দেশে আর মারামারি-কাটাকাটি নয়, সবাই ভালোভাবে বেঁচে থাকুক—তাই যাদের সম্ভব সাধারণ ক্ষমা বা মাফ করে দিয়েছিলেন। আর আপনি তো নারী, মায়ের জাতি, সব সময় অন্যকে আঘাত দিয়ে কথা না বললে কী হয়? একটু মানবতা, একটু দরদি মনোভাব নিলে কত কী আর ক্ষতি হবে? সরকার বা দলের স্টান্ট হিসেবে নেহাতই যদি বলতে হতো নিজে নীরব থেকে অন্যকে দিয়ে বলাতেন। এত শক্ত কথা এখন না বললেই কি হতো না? আপনি তো এখন আর কোনো ব্যক্তি নন। আপনি তো দেশের প্রধান সেবক। শুধু আপনার দলের নন, গোটা দেশের। ইলিয়াসের স্ত্রীকে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলাম। দুই ছেলেকে বাড়ি পাইনি। কিন্তু আল্লাহর দান আমার কুশির মতো ছোট্ট মেয়ের বেদনার্ত মুখ দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। আমাদের স্বামী-স্ত্রী দু’জনের চোখে অঝোরে পানি ঝরেছে। তাই বলছি, আমি কোনো হরতাল সমর্থন করি না, কিন্তু ইলিয়াসের জন্য এ হরতাল সমর্থন না করে কোনো উপায় নেই। এ হরতাল শুধু ইলিয়াসের জন্য নয়, এটা আমার জন্য আর সন্তান-সন্ততির নিরাপত্তার জন্য, সর্বোপরি বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষের জীবনের জন্য। তাই এ হরতালকে অবশ্য অবশ্যই সমর্থন করি। তাই নেত্রীর নির্দেশে ইলিয়াস পালিয়ে থাকতে পারে, আপনার কথাই যেন সত্য হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আপনার কথা যেন কবুল ও মঞ্জুর করেন। তবুও বেঁচে থেকে সে যেন তার সন্তান-সন্ততি আপনজনের কাছে ফিরে আসে। আপনিই জয়ী হোন। ইলিয়াস আলী এবং তার গাড়ির চালক আনসার সহি-সালামতে ঘরে ফিরুক—এটা দেশবাসীর কামনা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সবিনয় নিবেদন, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তো নয়ই, ইলিয়াস আলী এবং তার গাড়িচালকের ব্যাপারটি একেবারেই মানবিক দিক থেকে বিচার করুন। তা না হলে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যেহেতু আপনি প্রধানমন্ত্রী, সেহেতু নিশ্চয়ই আপনি সবার চেয়ে বেশি জানেন এবং বোঝেন। এটা তো সব সময় আপনার কথাবার্তায় বোঝাও যায়। রেলওয়ের দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করেছিলেন। আপনি কেন তাকে আবার দায়িত্বহীন মন্ত্রী বানালেন, তা আপনারই ভালো জানা। তাহলে কি শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নয়, সব দুর্নীতির সঙ্গে সরকার জড়িত? বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমদের ছেলে সোহেল তাজ ৩৩ মাস আগে পদত্যাগ করেছেন। ৩৩ মাসে সেই পদত্যাগপত্র মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে আপনার দফতর পাঠাতে পারেনি। তাই তিনি এখনও মন্ত্রী। আপনি কি ইচ্ছা করলেই কেউ কাজ না করলেও সাধারণ মানুষের রক্ত-ঘামের পয়সা এভাবে দিতে পারেন? এটা কি অযোগ্যতা নয়, ব্যর্থতা নয় বা সাদা কথায় দুর্নীতি নয়? কেউ মন্ত্রী হলে তাকে কাজ করতে হবে। এটা তো কারো পৈতৃক তালুক নয়, জনগণের দেশ। কেন আপনি তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলেন না? আর যদি পদত্যাগ গ্রহণ না করে থাকেন তাহলে তিনি কেন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেন না, তার জবাব কে দেবে? আপনি যত ক্ষমতাবানই হোন ঘোড়া-গরু-গাধা-বাঘ-ভাল্লুককে পানির আধারের কাছে নিতে পারেন। সে নিজে পানি পান না করলে হিটলার হলেও তাকে জোর করে পান করাতে পারবেন না। তিনি কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব, গুরুত্বহীন মন্ত্রিত্ব করতে চান না।

নিজে নিজের মতো থাকতে চান। তাহলে কেন তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে এভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করছেন? তবে কি তার বাপ-চাচাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়ার অপবাদ ঘোচাতে চান? সে সুযোগ এখানে কোথায়? তাই জোর মিনতি করি—দেশ এবং দেশের সংবিধান একেবারে ধ্বংস করে দেবেন না।

পূর্বের অংশ