Sunday, January 19, 2014

যে দেশের সরকার নিজেই নিজের নাগরিকদের উপর সশস্ত্র ও সহিংস অভিযান চালায়, সেই দেশে প্রতিরোধ সংগ্রামকে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ থাকতে বলা চূড়ান্ত কপটতা

হাসিনার নয় দফা ও আন্দোলনের ধরণ
ফরহাদ মজহার
১৯ জানুয়ারি ২০১৪, রবিবার, দৈনিক নয়া দিগন্ত।

বোঝা যাচ্ছে আন্দোলনের একটা বিরতি ঘটেছে। খালেদা জিয়া ১৫ তারিখে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। ২০ জানুয়ারি গণসমাবেশ ও ২৯ তারিখে কালোপতাকা মিছিল। অন্যদিকে খবর খুব দ্রুত ঘটছে। অনেক খবর তাদের প্রিন্টিং প্রেস সমেত সিলগালাও হয়ে যাচ্ছে। তিনটি বিষয় খবর হিসাবে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি বিরতির ঘোষণা দিয়ে খালেদা জিয়ার সাংবাদিক সম্মেলন এবং আন্দোলনের সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি; এর একটা নির্মোহ বিচার দরকার। দ্বিতীয় খবর হচ্ছে, যুক্তরাজ্যের হাউজ অব কমন্স এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্ক; গণআন্দোলনবিদ্বেষী গণমাধ্যমগুলোর বিকৃত ব্যাখ্যার বাইরে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে আন্তর্জাতিক জনমত ঠিকভাবে বোঝা দরকার।

এবং তৃতীয়টি গুজব। বাস্তবতার কারণে কোন কোন ঘটনার সত্য-মিথ্যার বিচার রাজনীতিতে গৌণ হয়ে যায়। গুজবই নির্ধারক হয়ে ওঠে। সাতীরায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ সত্য কি মিথ্যা সেই তর্ক এখন গৌণ। ক্ষমতাসীনদের কীসের এতো ভয় যে গুজবকেও সিলগালা করে দিতে হবে? সাংবাদিকদের অফিস থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে কারাগারে পুরতে হবে?

শুরুতে সাম্প্রতিক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির বিচারের মধ্যে এ লেখাটিকে সীমিত রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশে গণআন্দোলনের ইতিহাস ও আন্দোলনের ধরণ সম্পর্কে খানিক ধারণা না নিলে আন্দোলনের বিচার একদেশদর্শী হয়ে যাবার ভয় রয়েছে। অন্যদিকে গণবিরোধী ফ্যাসিস্ট শক্তি গণআন্দোলনকে শক্তিশালী হতে দেবে না, এটা জানা কথা। একে বিরোধিতা করবার েেত্র তাদের প্রধান মতাদর্শিক ল্য জামায়াত-শিবির ও হেফাজতে ইসলাম। এটা পরিষ্কার যে মাঠ পর্যায়ে গণশক্তির ভিত্তি এখানে। তাহলে আন্দোলনকে গতিশীল করতে হলে গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রাম ও গণশক্তি পরিগঠনের দিক থকে ইসলামপন্থী আন্দোলনের ভূমিকারও একটি নিরাবেগ ও নির্মোহ পর্যালোচনা দরকার।

আন্দোলনের চরিত্র আর আন্দোলনের নেতৃত্বের চরিত্রকে গুলিয়ে ফেলা নতুন কিছু নয়। অনেকে বিএনপি ও আঠারো দলীয় জোটের শ্রেণি চরিত্র দিয়ে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের লড়াইয়ের চরিত্র মাপেন এবং তার সীমা ও সম্ভাবনা বোঝার চেষ্টা করে পেরেশান হয়ে যান। ফলে বিএনপির ব্যর্থতাকে গণআন্দোলনের ব্যর্থতা বলে ভুল করেন। অন্যদিকে নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের ধারণা জনগণের এখন একটাই কাজ : বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানো। যাতে দুর্নীতি ও রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন আগের মতোই চলতে পারে।  ক্ষমতাসীনদের গণমাধ্যমগুলো অবশ্য আন্দোলনকে নিরাশ করবার জন্য বেগম জিয়া কী ভুলটাই না করেছেন সেই কেচ্ছা দিনরাত গেয়ে যাচ্ছে। তাদের হাহাকার হচ্ছে খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের শর্তে নির্বাচন করলে এখন ক্ষমতায় থাকতেন। তাদের আশা ছিল ক্ষমতাসীনদের শর্তে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন এবং বাংলাদেশে সব কিছু আগের মতোই চলতে থাকবে। অথচ সংবিধানের ন্যূনতম সংস্কারও যদি খালেদা করতে চান তাহলে তাঁকে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেতে হবে। শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে নির্বাচন করলে সেটা সম্ভব হোত না।  নির্বাচন যে সুষ্ঠু হোত না সেটা তো চাক্ষুষ সকলেই এখন দেখল। ফলে সংবিধান সংস্কার দূরের কথা, ক্ষমতায় ফিরে আসাও অসম্ভব হোত। সংস্কার না হলে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভূত সাংবিধানিক কারণে খালেদা জিয়াকে কিভাবে বহন করতে হোত সেটা যারা বুঝতে চান তারা পঞ্চদশ সংশোধনী মনোযোগ দিয়ে পড়বেন, আশা করি। শেখ হাসিনার অধীনে বেগম জিয়ার নির্বাচনে না যাবার যুক্তি আর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নিজস্ব গতি ও সম্ভাব্য পরিণতি সমান্তরাল নয়। এই টানাপড়েন খালেদা জিয়া যেভাবে বোঝেন তিনি সেভাবেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ও দেবেন। আন্দোলন তিনি কতোটুকু নিয়ে যেতে চান এবং জনগণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের রাজনীতি কী হবে সেটাও নির্ভর করবে তাঁর এই উপলব্ধির ওপর। তেমনি আন্দোলনের মাঠপর্যায়ের কর্মীদেরও নিজেদের মাঠের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে হবে জনগণ কী চায়, আর সেই প্রত্যাশার ভার বইবার মতা বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোটের কতোটুকু। বলা বাহুল্য, আমাদের আগ্রহ ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলনে, তাদের সাহসী সংগ্রামে। আমাদের লেখালিখিও সেই আলোকেই পাঠ করলে খুশি হবো।

বলে রাখা দরকার, আমরা দাবি করি না জামায়াতে ইসলাম কিম্বা হেফাজতে ইসলাম সমালোচনার ঊর্ধ্বে, অবশ্যই নয়; সাধারণভাবে ইসলামপন্থী ধর্মান্দোলন ও রাজনীতির পর্যালোচনা বাংলাদেশে খুবই জরুরি, কিন্তু ফ্যাসিস্টরা তাদের মতাদর্শ ও গণবিরোধী ভূমিকা আড়াল করবার জন্যই নরম লক্ষ্যবস্তু হিসাবে বারবার ইসলামকে সামনে হাজির করে। একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার জন্য এটা সবচেয়ে সস্তা ও সহজ কাজ। অথচ একটি ২০/২৫ বছরের যুবক, যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখে নি, সেই ছেলেটি কী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে শহিদ হয় কিম্বা শহিদ হতে চায়, সেই দিকগুলো আমরা কখনই বোঝার চেষ্টা করি নি। যারা তাদের আদর্শ ও সংকল্পের জন্য জীবন দিতে রাজি থাকে, তাদের গুলি করে দমানো যায় না। সেই আদর্শ বা সংকল্প যতোই ভুল হোক তাকে সঠিক আদর্শ ও আরো পরিণত সংকল্প দিয়েই মোকাবিলা করতে হয়। গুলি আদর্শের বিকল্প হতে পারে নাÑ এই সহজ সত্য যতো তাড়াতাড়ি আমরা বুঝবো ও নির্মোহভাবে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী আন্দোলন পর্যালোচনা করতে শিখব, ততো তাড়াতাড়ি এই ভয়াবহ পরিস্থিতি আমরা অতিক্রম করে যেতে পারব।

আমরা দেখছি যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও দমনপীড়নের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আন্দোলনের ধরণ সমালোচনার প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মতাদর্শিক বিভাজন দিয়ে আন্দোলনকে বিভক্ত করবার জন্য যেমন জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম ফ্যাসিস্টদের টার্গেট,  ঠিক তেমনি আন্দোলনের ধরণকেও তারা আক্রমণের প্রধান ল্যবস্তুতে পরিণত করছে। এটা খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। ভাবখানা এ রকম যে বাংলাদেশে আন্দোলনের বর্তমান সহিংস ধরণ নতুন। অথচ আন্দোলনের বর্তমান ধরণ আওয়ামী লীগের হাত ধরেই বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে।   ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি ও তাদের রাজনৈতিক চর্চাকে ভুলে গিয়ে ও বাদ রেখে আন্দোলনের ধরণ নিয়ে সমালোচনা চরম অসততা ও কপটতা। আজ তাই শুরুতে একটু পুরানা তথ্য নাড়াচাড়া করব।

দেশে এখন কার্যত কোন বৈধ সরকার নেই...’-শেখ হাসিনা, ১৯৯৬।

একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করি। উদ্ধৃতিটি এ রকম :

দেশবাসী ... সরকারের একদলীয় নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। ... নীলনকশার নির্বাচনের ক্ষমতাসীন ... সরকারের আর কোন আইনগত ও সাংবিধানিক বৈধতা নেই। সরকার এখন অসাংবিধানিক। তাই দেশে এখন কার্যত কোন বৈধ সরকার নেই

না। এটা খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন নয়, শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন। সাল ১৯৯৬। বৈধ সরকার নাই, আছেন শুধু রাষ্ট্রপতি, রাষ্ট্রের প্রধান, সংবিধানের প্রতীকী উপস্থিতি। শক্তিও অতোটুকুই। শেখ হাসিনা তখনকার রাষ্ট্রপতিকে তাঁর ওপর অর্পিত সাংবিধানিক মতা ব্যবহার করবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই মতা ব্যবহার করে তিনি একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করবেন, আর ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবেন। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতিকে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘অবৈধ সরকারকে বরখাস্ত করে নতুন নির্বাচন দিন।

আমাদের স্মৃতিশক্তি কম। সেটা অপুষ্টি বা আয়োডিনের অভাব থেকে হতে পারে। সেটা ডাক্তার কিম্বা পুষ্টিবিদরা ভালো বুঝবেন। তবে পৃথিবীতে অন্য কোন জনগোষ্ঠির স্মৃতিপদার্থ এতো স্বল্প মনে হয় না। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গে পরে আসি, আরেকটু পেছনে ১৯৮৮ সালে যাই।

বাংলাদেশে ৪র্থ জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছিল ৩ মার্চ ১৯৮৮ সালে। তখন গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো বাংলাদেশের প্রায় সব কয়টি প্রধান রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করেছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তো ছিলই, এই দুটো দল ছাড়াও নির্বাচন বর্জন করেছিল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) এবং ওয়ার্কার্স পার্টি। নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৫১ আসনে জাতীয় পার্টি জিতেছে বলে দাবি করা হয়। ভোট পড়েছিল সরকারী হিসাবে ৫২.৫০%।

নির্বাচনের দিন বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনা সেই সময়ের আটদলীয় জোটের পক্ষে সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু ভবনে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল পরিষ্কার : সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে। তাঁর যুক্তি, জনগণ নির্বাচনে ভোট দেয় নি, ভোট প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘নির্বাচন প্রতিরোধ আন্দোলনেএবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের সংঘর্ষে ১০ ব্যক্তি নিহত হয়েছে। তার মধ্যে ঢাকায় ৮ জন ও চট্টগ্রামে ২ জন। সেই সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ হাসিনা গর্ব করে বলেছিলেন, ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া, পাবনা, সিলেট, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুরসহ দেশের প্রায় সর্বত্র বহু জায়গায় জনগণ ভোট কেন্দ্র পুড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকার আরমানিটোলা, শেরেবাংলা নগর, মিরপুর, মগবাজার, টিএন্ডটি, পল্টন মহিলা কলেজ, গাবতলী, লালবাগ, লেডিস কাব, আজিমপুর, নুরজাহান রোড, ভূতের গলি, গ্রাজুয়েট স্কুল, নবাবপুর, ওয়ারী, সূত্রাপুর, গোলাপবাগ, লালকুঠিসহ নানান জায়গায় জনতা প্রতিরোধ রচনা করে। ব্যাপক সহিংসতা ঘটে। নির্বাচন বানচাল করতে সহিংসতায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিয়েছিল। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাস ও সহিংসতা মোটেও নতুন কিছু নয়।

সেই সময় শেখ হাসিনা কী বলেছিলেন তা আমাদের জন্য এখনও দারুণ শিণীয় হতে পারে। আমি ১৯৮৮ সালের ৪ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাক থেকে টুকছি তাদের তখনকার ভাষার বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে, তাদের সাংবাদিকতার সততার ওপর আস্থা রেখে। তাছাড়া হাতের কাছে ইত্তেফাক আর দৈনিক সংবাদের প্রতিবেদন পেয়েছি, আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন সাংবাদিকের অনুসন্ধানী পরিশ্রমের ফল হিসাবে। পত্রিকার সংবাদ পরখ করবার সময় ও সুযোগ না পেলেও আমি নিশ্চিত এই উদ্ধৃতি প্রামাণ্য। যে কেউই খুঁজে দেখতে পারেন। সেই সময়ের দৈনিক পত্রিকাগুলো থেকে আরো অনেক ইন্টারেস্টিং মালমসলা গবেষণা করে বের করা যেতে পারে। 

ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী শেখ হাসিনা সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন : আমরা আগেই বলিয়াছি, একটি গোষ্ঠির স্বার্থরার জন্যই এ নির্বাচনের আয়োজন করা হইয়াছে। দুর্ভাগ্যবশত উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সরকার গঠনে জনগণের কোন ভূমিকা নাই। কোন অবস্থাতেই এ পরিস্থিতি মানিয়া নেওয়া যায় না। তিনি দলীয় নেতা আবদুল মান্নান, বেগম সাজেদা চৌধুরীসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি এবং বাংলার বাণী, খবর, বিবিসিসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত সকল সংবাদপত্র ও সংবাদসংস্থার উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানান।তাঁর এই বক্তব্যে যে-পরিস্থিতির তিনি উল্লেখ করেছেন তার সঙ্গে এখনকার অবস্থা আমি সকল বিবেকবান মানুষকে তুলনা করতে বলি। ঠিকই। কোন অবস্থাতেই এ পরিস্থিতি মানিয়া নেওয়া যায় না।সেই ১৯৮৮ সালে যেমন তেমনি এখনও। দুই হাজার চৌদ্দ সালেও। (দেখুন, ‘জনগণ এই নির্বাচনে ভোট দেয় নাই’, শেখ হাসিনা; দৈনিক ইত্তেফাক ৪ মার্চ ১৯৮৮)। সাংবাদিক সম্মেলনে অনেকে ছিলেন, তাঁদের মনে থাকার কথা। ড. কামাল হোসেন, আবদুল মমিন, আবদুল জলিল, তোফায়েল আহমেদ, শেখ সেলিম, খ. ম. জাহাঙ্গীর ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তো সেই সংবাদ সম্মেলনে হাজির ছিলেন। শেখ হাসিনার এই বক্তব্যের সাী তাঁরাও। দৈনিক সংবাদ (৪ মার্চ ১৯৮৮) থেকে জানা যায় শেখ হাসিনা বলেছিলেন এরশাদ সরকারের হাতে সংবিধান ও গণতন্ত্র কোনটাই নিরাপদ নয়। এই সরকার বন্দুকের জোরে মতায় টিকে আছে। সরকার ভোটের প্রক্রিয়া নষ্ট করে দিয়েছে এবং যে কোন মূল্যে মতায় টিকে থাকতে চায়। সরকার দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। স্বৈরশাসন পাকাপোক্ত করতে এবং গণধিকৃত বিশেষ একটি গোষ্ঠির স্বার্থ রার জন্য চক্রান্তচলছে। জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের নির্বাচনী চক্রান্ত ব্যর্থ করেছে। ইত্যাদি বিস্তর কথা। শেখ হাসিনা এটাও জানিয়েছিলেন সেই সময় সংসদ ও ৪টি পৌর কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজধানী এবং চট্টগ্রামে ১০ জন নিহত হয়েছে। সন্ত্রাস ও সহিংসতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে মোটেও নতুন কিছু নয়।

এবার আসা যাক ১৯৯৬ সালে। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে। তার আগে থেকেই আওয়ামী লীগ হরতাল, ধর্মঘট ও বিভিন্ন সহিংস কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের চেষ্টা করে। তারা ১৯৯৪ সালের পর থেকে পার্লামেন্টও বর্জন করে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য তীব্র আন্দোলন শুরু করে দেয়। প্রায় সব বিরোধী দলই ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছিল। ভোট পড়েছিল মাত্র শতকরা ২১ ভাগ। তিন শআসনের মধ্যে অধিকাংশই বিজয়ী হয়েছিল, বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। এই নির্বাচন মূলত আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্যই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী ২৮ মার্চ ১৯৯৬ তারিখে গৃহীত হবার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জুন মাসে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার পর সেদিনই সন্ধ্যায় ধানমন্ডিতে তাঁর বাসভবনে শেখ হাসিনা যথারীতি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। এবারও শেখ হাসিনা বলেন, বিরোধী দলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জনগণ প্রহসনের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি প্রেসিডেন্টকে ৯০ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে নির্বাচন করবার আহ্বান জানান। কিন্তু কিভাবে সেটা আইনি বা সাংবিধানিকভাবে সম্ভব? তাঁর যুক্তি ছিল প্রেসিডেন্ট তার সাংবিধানিক ক্ষমতাপ্রয়োগ করে সেটা করতে পারেন। সে মতা প্রয়োগ করে তিনি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি অথবা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কোনো একজন বিচারক কিম্বা দেশের একজন বিশিষ্ট নাগরিকের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করবেন এবং ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন।

সেই সময় শেখ হাসিনা ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে যা বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া বর্তমান নির্বাচন সম্পর্কেও হুবহু একই কথা বলতে পারেন। শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে দেশের ৯৫ ভাগ লোক সরকারের প্রতি অনাস্থা ব্যক্ত করেছে। ফলে সরকার দেশ শাসনের কর্তৃত্ব ও বৈধতাহারিয়েছে। জনগণের এই রায়ের পর বাংলাদেশের মাটিতে বিএনপি সরকারের আর কোন অস্তিত্ব নাই বলেও তিনি দাবি করেছেন। বিএনপি সরকারের একদলীয় প্রহসনের নির্বাচন প্রত্যাখ্যানকরে তিনি দেশবাসীর প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘অতীতেও জাতি কোন স্বৈরাচার ও তাদের সহযোগীদের হুমকি ও ভয়ভীতির কাছে মাথা নত করে নি। বলেছেন, ‘বিএনপির নির্লজ্জ মহড়া কাউকেই ভোট কেন্দ্রে নিতে পারে নি।

জনগণকে এই সংকটময় মুহূর্তে ধৈর্য ধারণকরবার আহ্বান জানাতেও তিনি ভোলেন নি। নিরাপত্তা বাহিনী এবং বিএনপির ক্যাডারদের হাতে কিছু সংখ্যক নিরীহ মানুষ নিহত ও বহু আহত হওয়ায় সেই দিন ােভ প্রকাশ করেছেন। এখন অবশ্য ২০১৪ সালে তার হাতেই নিরীহ মানুষ নিহত ও আহত হচ্ছে। বহু বিরোধীদলীয় কর্মীকে গ্রেফতার করার প্রতিবাদ করেছিলেন। এখন অবশ্য বিএনপির প্রায় পুরো নেতৃত্বকে গ্রেফতার করেও ক্ষান্ত হন নি, বেগম খালেদা জিয়াকেও গৃহবন্দী করে রেখেছেন। হিংসাত্মক কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন সেই দিন। এখন যেমন খালেদাও জানাচ্ছেন।

ভোট সম্পর্কে তিনি সংবাদপত্রের বরাত দিয়ে নিজের একটা বর্ণনাও হাজির করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী সত্যিকার ভোটার ভোট কেন্দ্রে যায় নি, কোন কোন কেন্দ্রে একজনও না। বিদেশি পর্যবেক্ষকসহ নিরপেক্ষ পর্যবেকদের অভিমত অনুযায়ী অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র ছিল সারাদিন জনশূন্য। বিপুল সংখ্যক কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার পোলিং অফিসার ছিলেন না। তারা পেশাজীবী সংগঠনসমূহের আহ্বানে সাড়া দিয়া প্রহসনের নির্বাচন বর্জন করেছে। তবে আলোকচিত্র সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ল্েয কিছু কিছু কেন্দ্রে ভয়ভীতি দেখিয়ে বা অর্থ ছড়িয়ে গরীব মানুষদের হাজির করেছে সরকার। তাদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা হয়েছিল। কাজেই ভোট পড়েছে বলে সংখ্যা যতই দেখানো হোক সেই সংখ্যা আসলে বানোয়াট এবং অগ্রহণযোগ্য। তত্ত্বকথাও বলেছেন। যেমন, সামরিক একনায়কতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য। সামরিক একনায়কতন্ত্রে মতার উৎস হোল বন্দুকের নল, কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে দেশ শাসনের জন্য ভোটের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নিতে হয়। শেখ হাসিনা তখন এই নীতি বিশ্বাস করতেন কি না বলা কঠিন। তবে এখন যে এইসব শীতকালীন সর্দি অনেক আগেই নাক থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন তা পরিষ্কার। এ সবই তিনি বলেছিলেন ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের সাংবাদিক সম্মেলনে। আগ্রহী পাঠক ১৬ ফেব্রুয়ারির ইত্তেফাকের খবর পড়ে দেখতে পারেন। শিরোনাম : প্রেসিডেন্টের প্রতি শেখ হাসিনার আহ্বান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করিয়া ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দিন

শেখ হাসিনা তখন দাবি করেছিলেন, “আমাদের ল্য একটি নির্দলীয় নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। যেহেতু এ সরকার মতায় থাকার আইনগত বৈধতা হারাইয়াছে, সেহেতু আমি দেশবাসী এবং আন্তর্জাতিক েেত্র আমাদের সুহৃদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলতে চাই এখন থেকে এ সরকারের আদেশ-নির্দেশ, কার্যক্রম, অঙ্গীকার কোন কিছুরই আর কোন আইনগত বৈধতা থাকিবে না।ঠিক একই ঘোষণা বিএনপিও এখন দিতে পারত। কিন্তু বিএনপির সেই হিম্মত নাই, রাজনৈতিক দূরদর্শিতারও প্রকট অভাব রয়েছে। স্মৃতিপদার্থের অভাব অন্যদের কম থাকলে অসুবিধা হয় না। কিন্তু জাতীয় রাজনৈতিক দল যখন ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, তখন তার দায় তার নিজেকেই নিতে হয়।

শেখ হাসিনার নয় দফা ও আন্দোলনের ধরণ

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল শেখ হাসিনার সাংবাদিক সম্মেলনে। বিএনপি সরকারের অবর্তমানে দেশে যাতে কোন সংকট সৃষ্টি না হয় সেই ল্েয জনগণ ও সকল রাজনৈতিক দল মিলে প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসনকে সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করবার কথাও বলেছিলেন। অর্থাৎ শেখ হাসিনা বিএনপিকে মতা থেকে উৎখাত করবার জন্য আইনি পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকে যে বুদ্ধিমান কৌশল অবলম্বন করা দরকার সেটা করেছিলেন।

সে সময় শেখ হাসিনা তাঁর বিখ্যাত ৯ দফা নীতিমালা ঘোষণা করেন। ইতিহাসের রহস্য বা প্রহসন বুঝতে হলে এই নয় দফা আমাদের ভুলে যাওয়া মোটেও ঠিক না। এখানে তাই শেখ হাসিনার নয় দফা আমি উদ্ধৃত করছি। (ইত্তেফাক ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৬)

১। বিএনপি সরকারের আহ্বানে দেশের ৯৫ শতাংশের অধিক জনসাধারণ ভোটদান না করার মধ্য দিয়ে সরকারের প্রতি অনাস্থা ব্যক্ত করেছে এবং একই সঙ্গে বিরোধী দলের প্রতি তাদের আস্থা ও সমর্থন ব্যক্ত করিয়াছে।

২। জনসাধারণের বিপুল রায়ে বিএনপি সরকার দেশ শাসনের কর্তৃত্ব ও বৈধতা হারাইয়াছে। জনসাধারণের এই রায়ের পর বাংলাদেশের মাটিতে বিএনপি সরকারের আর কোন অস্তিত্ব নাই।

৩। যেহেতু বিএনপি সরকার এখন আর বৈধ সরকার নয়, সেহেতু সাংবিধানিক সংকট এড়াবার জন্য দেশের সকল আইনসঙ্গত কর্তৃত্ব ও প্রশাসন এখন প্রেসিডেন্টের উপর ন্যস্ত হতে হবে।

৪। সকল প্রশাসনিক কাঠামো, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সশস্ত্র বাহিনীসহ সকল আইনসঙ্গত সংস্থা এখন সরাসরি প্রেসিডেন্টের নিকট হইতে আদেশ গ্রহণ করবে।

৫। প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট সচিবগণ বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনা করিবেন।

৬। টিএনও, ডিসি, বিভাগীয় কমিশনার, এসপি, পুলিশ কমিশনার এবং থানা, জেলা ও বিভাগের অন্যান্য আইনসঙ্গত সংস্থাগুলি সরাসরি সংশ্লিষ্ট সচিবগণের নিকট থেকে আদেশ গ্রহণ করবেন।

৭। তিন বাহিনী প্রধান, ক্যাবিনেট সচিব এবং সকল সচিব প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সরকার পরিচালনা করিবেন।

৮। দেশে যেন কোন সংকট সৃষ্টি না হয় সেজন্য বিএনপি সরকারের অনুপস্থিতিতে দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ এবং সকল রাজনৈতিক দল প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসনকে সার্বিক সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করবে, এবং
৯। দেশের জনগণের পক্ষে আমরা এখন অবিলম্বে প্রেসিডেন্টের সাংবিধানিক মতা প্রয়োগ এবং ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি অথবা এ্যাপিলেট ডিভিশনের একজন বিচারপতি অথবা দেশের একজন বিশিষ্ট নাগরিকের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ জানাচ্ছি। (দেখুন দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬)।

আজ এতোটুকুই থাক। লেখাটি শেখ হাসিনাকে নিন্দা করার জন্য লিখি নি। যারা এতদিন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিলেন তাদের একটু ইতিহাস সচেতন করবার চেষ্টা করছি মাত্র।

সন্ত্রাস ও সহিংসতা বাংলাদেশের রাজনীতির ধর্ম। এটা ষাট দশক থেকেই শুরু হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রতিভা অবিসংবাদিত। এটা সমালোচনা নয়। বিদ্যমান ক্ষমতার দমনমূলক ও সশস্ত্রতার চরিত্র অনুযায়ী এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, গণবিক্ষোভ, গণআন্দোলন ও গণসংগ্রাম রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেই সহিংস ও সশস্ত্র হয়। হতে বাধ্য। এটা চাওয়া না চাওয়া ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার নয়, সহিংসতা ত্যাগ করা না করার মামলাও নয়।

যে রাষ্ট্রে নাগরিক ও মানবিক অধিকার স্বীকৃত, বিচার বিভাগের কাছে অন্যায়ের নালিশ জানালে প্রতিকার পাওয়া যায়, নাগরিকদের কথা বলার স্বাধীনতা স্বীকৃত, আইন যেখানে নাগরিকদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেয়, পুলিশ ও আইনশৃংখলা বাহিনী যে দেশে নাগরিকদের রা করে, গুম করে না; আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালায় না, কিম্বা যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে যে দেশের সরকার নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ও সহিংস অভিযান চালায় না; সেই দেশে অবশ্যই শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন সম্ভব।

কিন্তু নাগরিকদের অধিকার পদদলিত করে যে দেশের সরকার নিজেই নিজের নাগরিকদের উপর সশস্ত্র ও সহিংস অভিযান চালায়, সেই দেশে প্রতিরোধ গণআন্দোলন গণসংগ্রামকে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ থাকতে বলা চূড়ান্ত কপটতা অথবা বিশুদ্ধ আহাম্মকি ছাড়া কিছু নয়।

 অথচ মানুষ ঠিক এই অধিকারগুলো আদায়ের জন্যই আন্দোলন-সংগ্রাম করে। পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের হিংস্র মতার মুখে বাংলাদেশের জনগণকে অস্ত্র ধরতে হয়েছিল, যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধবলি। মুক্তিযুদ্ধ সহিংসই ছিল অহিংস ছিল না। বাংলাদেশে জনগণের মুক্তির সংকল্প পাকিস্তানি সংবিধান আইন কিছুই মানে নি।

যারা ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের লড়াই সংগ্রামকে সহিংস ও সশস্ত্র বলে এক তরফা নিন্দা করছেন, আশা করি তাঁরা ইতিহাস পড়বেন। ফ্যাসিবাদ নিজে সশস্ত্র ও সহিংস অথচ জনগণকে শান্তি ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা বলে। যারা শান্তির নসিহত করতে শুরু করেছেন তাদের জন্য করুণা ছাড়া কী আর করার আছে।

তবু বলব আমরা নিয়মে বিশ্বাস করি, নইলে সমাজ টেকে না। হিংসা পরিহার করাই শ্রেষ্ঠ নীতি, কারণ হিংসা আমাকেও গ্রাস করতে পারে। আসলে নৈতিক সংবেদনার প্রতি সাড়া দেওয়া কিম্বা অপরের প্রতি উদার ও সহনশীল হবার সামাজিক তাগিদে অহিংসা চর্চা আমাদের সহজাত; নিয়মের মধ্যে দাবিদাওয়া আদায়ের চেষ্টাই মানুষ করে। কিন্তু যাদের নিয়ম রা করবার কথা তারা যখন তা ভঙ্গ করে তখন নিয়মের মধ্যে থাকবে কে? নিয়মের মধ্যে চলা নিয়মের অভ্যাসে বেড়ে ওঠা মানুষের স্বাভাবিক চরিত্র। কিন্তু যে-রাষ্ট্র নিরন্তর সেই নিয়ম ভঙ্গ করে সেই রাষ্ট্রে নিয়ম মানার অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। বারবার বলা কঠিন নয় যে নিয়মের মধ্যে থাকার নৈতিক প্রবণতা ও হিংসার বিরুদ্ধে মানুষের সংবেদনা অমূল্য এবং তার চর্চা সমাজে অবশ্যই দরকার। কিন্তু যে নিয়ম আদতে অনিয়ম, তাকে ভাঙা ছাড়া নিয়মের প্রবর্তন কী করে সম্ভব? যে অহিংসার বয়ান হিংসার ওপর দাঁড়ানোÑ যার পেছনে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দানবের মতো দাঁত বের করে আমাদের গিলে খেতে চায়, তাকে জনগণ মানবে কেন? অনেককে দেখছি তবুও রাষ্ট্রের অনিয়ম ও হিংসা অত ও বহাল রাখার জন্যই গণআন্দোলন গণসংগ্রামকে নিয়মতান্ত্রিক ও অহিংস হবার নসিহত দিয়ে যাচ্ছে। নির্বিচারে। এই অসম্ভব দাবি সরব হয়েছে বেশ।

যারা নিয়মতান্ত্রিক অহিংস গণআন্দোলন দেখতে পাবার আবদার করছেন তারা ধরে নিয়েছেন যেন যে-রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন সেই রাষ্ট্র বুঝি নিয়মতান্ত্রিক আচরণ করছে; মানে নাগরিকের গণতান্ত্রিক মৌলিক ও মানবিক অধিকারের দিকটার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আচরণ করছে। কোন গণআন্দোলন সহিংস নাকি অহিংস হয়ে উঠবে তার নির্ধারক মতাসীন সরকার। মতাসীনদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা আন্দোলনকে নিয়মতান্ত্রিক ও অহিংস পরিমণ্ডলের মধ্যে সীমিত রাখতে চায় কি না। গণআন্দোলন অহিংস নাকি সহিংস হবে তার ট্রিগার সব সময়ই সরকারের হাতে থাকে। রাজনৈতিক বিরোধ সহিংস বলপ্রয়োগে দমন করে সুবিধা আদায়ের সরকারী আচরণ থেকে এখনকার সহিংসতার জন্ম। এই পরিস্থিতিতে একতরফা গণআন্দোলন ও সহিংসতা নিন্দা করার একটাই অর্থ, কৌশলে ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়ানো, সাফাই গাওয়া।

রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে অসঙ্গতি থাকলেও দুই পক্ষের কারো প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন না করে নিরপেক্ষ জায়গায় দাঁড়িয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশের দাবি জানাচ্ছেন অনেকে। তাঁদের সংবেদনাকে সম্মান করা ছাড়া পথ থাকে না। কিন্তু বিদ্যমান সংঘটিত হিংসা ভিন্ন জিনিস। এই েেত্র শান্তির দাবি সহিংস রাষ্ট্রের উকিলগিরির অধিক কিছু নয়। রাজনীতি ও রাষ্ট্রের নির্মোহ বিচারে আদৌ তা কোন কাজে আসে না। নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে বিদ্যমান হিংস্র ব্যবস্থার নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা ও হত্যাযজ্ঞ সমর্থন করবার জন্য দুনিয়াতে কখনই লোকের অভাব হয় নি। আর সেটা সব সময়ই হয়েছে শান্তির নামে, নিয়মের নামে। গণআন্দোলন গণসংগ্রামের প্রতিরোধের ধরণ নিয়ে পর্যালোচনা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু আন্দোলনের রাজনৈতিক মর্ম বাদ দিয়ে তাকে নীতিবিদ্যায় পর্যবসিত করলে এতে নীতি ও রাজনীতি দুটোই অস্পষ্ট হয়ে পড়ে।

শেখ হাসিনা কী করে বিরোধী দলকে দমন করতে হয় জানেন। সেখানে তিনি নীতি মানেন না, নিয়ম মানেন না, সংবিধান আইন কিছুই মানেন না। কিন্তু বিএনপি আওয়ামী লীগের তুলনায় এই ক্ষেত্রে এখনও শৈশবাবস্থা পার করে নি বলা যায়। তবে মতাসীন থাকার সময় এই প্রতিভার চর্চা তারাও করেছিল। কিন্তু সত্য এই যে সন্ত্রাস ও সহিংসতায় আওয়ামী লীগের জুড়ি মেলা ভার। বাংলাদেশে আন্দোলনের যে সকল ধরণ নিয়ে এখন বিরোধী দলের সমালোচনা হচ্ছে তার সবই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চর্চা থেকে গড়ে উঠেছে, আওয়ামী লীগ একে জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত করেছে।
আবারও বলি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও সহিংসতা মোটেও নতুন কিছু নয়। কিন্তু স্মৃতিভ্রংশ কপটদের হঠাৎ সহিংসতার প্রশ্নে ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানি না ভাব দেখে বিস্মিতই হতে হয়। সহিংসতা কখনই কাম্য হতে পারে না, নীতিও নয়। ঠিক। কিন্তু রাষ্ট্র যেখানে সহিংস ও ত্রাস সৃষ্টিকারী সেই বাস্তবতায় আন্দোলনের ধরণ সহিংস কি অহিংস হবে সেটা আগাম নির্ধারণ করা কিভাবে সম্ভব?
এটাই তো প্রশ্ন।

১৮ জানুয়ারি ২০১৪। ৫ মাঘ ১৪২০। আরশি নগর।


(পরের কিস্তি : খালেদার জয়’)

Sunday, January 5, 2014

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ : হেফাজতের আন্দোলনে আমার সম্পৃক্ততার ব্যাখ্যা


ভারাক্রান্ত মন নিয়েই দিনাতিপাত করছি দেশের অবস্থা, মানুষের দুর্দশা, রাজনৈতিক অস্থিরতা- সব মিলিয়ে চরম অস্বস্তির মধ্যে সময় কাটছে আমি নিজে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অবস্থান করছি অথচ কী করব বুঝে উঠতে পারছি না সামনের সময়গুলো হয়তো আরও ভয়াবহ হবে কতগুলো অহেতুক ইস্যু রাজনৈতিক পরিবেশকে তমসাচ্ছন্ন করে ফেলেছে এসব ইস্যু সৃষ্টির জন্য সরকারকেই দায়ভার গ্রহণ করতে হবে যেমন 'গণজাগরণ মঞ্চ' সৃষ্টি এবং সেই মঞ্চকে কেন্দ্র করে 'হেফাজতে ইসলাম'-এর আবির্ভাব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যে সংঘাতের রাজনীতির উদ্ভব, তা আমার কাছে অহেতুক ইস্যু বলেই মনে হয়েছে এসবের মধ্যে আমার কিছুটা সংশ্লিষ্টতা এসেছে এখান থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি, যেহেতু আমিও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তবে যেটুকু সংশ্লিষ্টতা এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ যতটুকু না ছিল, ধর্মীয় অনুভূতির প্রশ্নটাই আমার কাছে অনেক বড় ছিল কারণ আমি পবিত্র ইসলাম এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অবমাননার বিষয়টি মেনে নিতে পারিনি আর অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের সমর্থন জানানোকে একটি ইমানি দায়িত্ব মনে করেছি আমি রাজনীতিবিদ না হলেও প্রশ্নে ব্যক্তিগতভাবে একই মনোভাব পোষণ করতাম প্রসঙ্গে আমার পক্ষে-বিপক্ষে কিছু অভিমত এসেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও আমাকে তির্যক বাক্যে আঘাত করেছেন এসব নিয়ে আমার অবস্থান ব্যাখ্যা করলে দেশবাসী হয়তো সঠিক বিষয়টি অবগত হতে পারবেন

যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কে আমি বা আমার দলের নীতির কথা ব্যক্ত করেছি বিচার কাজের সূচনালগ্নেই আমি বলেছি, যে কোনো অপরাধেরই বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয় মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ যা সংঘটিত হয়েছে তার বিচার ৪০ বছর পরে কেন, স্বাধীন দেশের যাত্রালগ্নেই হওয়া উচিত ছিল তবে দেরিতে হলেও সে বিচার যখন শুরু হয়েছে তখন তাকে আমরা প্রত্যাখ্যান করিনি বলেছি, বিচার যেন সুষ্ঠু এবং আন্তর্জাতিক মানের হয় মূলত যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে আলোচিত দুটি ইস্যুর সৃষ্টি হয়েছে বিচারের প্রথম রায় ঘোষিত হওয়ার পর দেশে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়নি দ্বিতীয় রায় ঘোষণার পর তরুণ সমাজের ঢাকাকেন্দ্রিক একটি অংশ শাহবাগে একত্রিত হয় তারা প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, 'এটা একটা আপসের রায় হয়েছে, রায় আমরা মানি না' সেই তরুণরা স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিল বলে আমিও তাদের অনুভূতিকে স্বাগত জানিয়েছিলাম পরে তাদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সংসদে একটি নতুন আইনও পাস হলো

পর্যন্ত ভালোই ছিল তাদের আন্দোলনে একটা বিজয় এসেছে, এখানেই ক্ষান্ত দেওয়া উচিত ছিল কিন্তু তা না করে ঘোষণা করা হলো, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে না ঝুলিয়ে তারা ঘরে ফিরবে না এবং শাহবাগের অবস্থানও ছাড়বে না অবস্থানের নাম দেওয়া হলো 'গণজাগরণ মঞ্চ' গণজাগরণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তিন স্তরে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হলো বিশ্বের ইতিহাসে কি এমন কোনো গণজাগরণের নজির পাওয়া যাবে, যে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গণজাগরণ মঞ্চ হয়েছে?

শাহবাগের দেখাদেখি দেশের প্রায় সব জেলা-উপজেলায়ও ধরনের মঞ্চ তৈরি হয়ে গেল যতক্ষণ পর্যন্ত দেশের তরুণ সমাজের মধ্যে প্রতীয়মান ছিল যে এটা একটি গণমুখী আন্দোলন এবং স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত ঐক্য, ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন সমর্থন পেয়েছে কিন্তু যে সময়ে স্পষ্ট হয়ে গেল এর পেছনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা রয়ে গেছে, তখন সারা দেশের মঞ্চ থেকে তরুণরা সরে যেতে লাগল আর সেই সুযোগে প্রতিপক্ষ একের পর এক মঞ্চ ভেঙে দিতে শুরু করল তখনো যদি মঞ্চ থেমে যায় তাহলেও পানি এতটা ঘোলা হয় না এরই মধ্যে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে ইসলামবিরোধী এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অবমাননাকারী ব্লগারদের দৌরাত্দ্য অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তার পাশাপাশি সেখানে এক প্যারালাল সরকারব্যবস্থা চালু হয়ে যায় তারা গোটা জাতিকে নির্দেশনা দিতে থাকে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের ঘোষণা আসে সব মিলিয়ে আমার কাছে মনে হলো, এরা ঔদ্ধত্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে অথচ কারও মুখে টুঁশব্দটি পর্যন্ত নেই অবস্থায় আমি আর চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না বললাম, ইসলাম অবমাননাকারী এবং প্রিয় নবী (সা.)-কে হেয়প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টাকারী ব্লগারদের ওই মঞ্চ অবিলম্বে ভেঙে দিন তা না হলে মহাবিপর্যয় নেমে আসবে ন্যক্কারজনক তৎপরতা কিন্তু জাতি মেনে নেবে না বাস্তবে ঘটেছেও তাই অল্প সময়ের মধ্যেই গোটা দেশের আলেম সমাজসহ ধর্মপ্রাণ মানুষ তেতে ওঠে সেই পর্যায়ে আমি আরও বলেছি, তোমরা কি বঙ্গবন্ধু হয়ে গেছ যে জাতিকে নির্দেশনা দিচ্ছ? জাতীয় পতাকা উত্তোলনের নির্দিষ্ট সময় আছে তা ভঙ্গ করে যে কেউ পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দিতে পারে না এটা মেনে নেওয়া জাতীয় চেতনার পরিপন্থী আমি এসবের প্রতিবাদ করেছি এটা যদি কোনো মহল দোষ বলে বিবেচনা করে থাকে তাহলে আমার বলার কিছু নেই

আমি ঘটনার সূচনায় প্রথম প্রতিবাদ জানিয়েছি আর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন হেফাজতে ইসলামের নামে দেশের আলেম-ওলামারা তাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে ইসলামপ্রিয় মানুষ হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয় তারা ক্ষমতা গ্রহণও করতে চায় না তাদের দাবি ছিল যারা পবিত্র ইসলাম মহানবী (সা.)-কে অবমাননা করেছে তাদের বিচার করা হোক শুরুতে তাদের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটা ঘোষণা এলেই পরিস্থিতি এতদূর গড়াত না বাহ্যত এখন মনে হতে পারে হেফাজতের আন্দোলন দমন হয়ে গেছে কিন্তু কার্যত কি তাই? আলেম সমাজের মনের আগুন কি নিভে গেছে? যে আঘাত তাদের মনে লেগেছে তা কি সহজে ভুলে যাওয়ার মতো? তা ভোলাতে হলে সরকারকে অবশ্যই আলেম-ওলামাদের পাশে ফিরে আসতে হবে পরিস্থিতির জন্য ক্ষমা চাইতে হবে ক্ষমাপ্রার্থনা অসম্মানের কিছু নয় ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্যে মনের উদারতা নমনীয়তার প্রকাশ ঘটে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট তারাও বহুবার ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও ক্ষমা চেয়ে হারানো ক্ষমতা আবার ফিরিয়ে নিয়েছেন দেশের মানুষ এখনো পাকিস্তানকে ভালো চোখে দেখে না, কারণ তারা বাংলাদেশে যে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তার জন্য এখনো ক্ষমাপ্রার্থনা করেনি দেশে জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং জামায়াতের ওপর দেশের সিংহভাগ মানুষের যে ক্ষোভ-ঘৃণা রয়েছে তার অবসান ঘটে যেত অনেক আগেই, যদি তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে তাদের কৃতকর্মের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইত তাহলে আজ যে তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হচ্ছে এবং জামায়াতের তরুণ অনুসারীদের যে ভোগান্তি-নির্যাতন-নিপীড়ন সইতে হচ্ছে, এর কোনোটারই মুখোমুখি হতে হতো না তাই সরকারের প্রতি আমার একটা পরামর্শ থাকবে_ যা ঘটেছে তার জন্য দেশের আলেম সমাজের কাছে ক্ষমা চেয়ে সব ভুলে গিয়ে আসুন আমরা সব পক্ষ শান্তি-স্থিতিশীলতা এবং দেশ জনগণের কল্যাণের পথে ফিরে আসি আলেম-ওলামারা যখন ঢাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ করতে এসেছিলেন তখন মেহমান হিসেবে আমার দলের পক্ষ থেকে তাদের পানি পান করানোর ব্যবস্থা করেছিলাম এটা কি দোষের কিছু করেছিলাম? সরকার যখন তাদের আসা এবং সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে, সেখানে তাদের সেবা দেওয়া কি অপরাধ ছিল?

মে ঢাকায় যা ঘটেছে তা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি এবং এখনো পারছি না হেফাজতের কর্মীরা ঢাকার চারপাশে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করে ঢাকায় প্রবেশ করেছেন গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন ভালো বলতে পারবেন, ঢাকার বাইরে থেকে যেসব মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক বা আলেম-ওলামা ঢাকায় প্রবেশ করেছেন, তাদের হাতে কি গাছ কাটা করাত-কুঠার জাতীয় কিছু দেখা গেছে? তাদের সঙ্গে এক বোতল পানি আর কিছু চিড়া-মুড়ি ছাড়া কিছু কি ছিল? তারা শাপলা চত্বর এলাকায় শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিয়ে বসে ছিলেন ওই সময় বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট পশ্চিম পাশে যা ঘটেছে সেখানে কি সত্যই কোনো হেফাজত কর্মী ছিলেন? গ্রাম থেকে যেসব মাদ্রাসা ছাত্র-শিক্ষক সেদিন ঢাকা এসেছিলেন, যারা এর আগে কখনো ঢাকা শহর দেখেনওনি, তাদের পক্ষে কি ওই ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করা আদৌ সম্ভব ছিল? যাদের ধ্যান-জ্ঞান শুধুই কোরআন-হাদিস, তাদের পক্ষে কি সেই কোরআন-হাদিসে আগুন লাগানোর কথা চিন্তা করাও সম্ভব? অথচ সব দোষ চাপানো হলো হেফাজতের নিরীহ কর্মীদের ওপর কী নির্দয়ভাবে মধ্যরাতে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হলো ওই রাতে কত আলেম-ওলামার প্রাণসংহার হয়েছে, কতজন শহীদ হয়েছেন, সেই সংখ্যার বিতর্কে আমি যেতে চাই না একজন হলেও তো শহীদ হয়েছেন সেই একজনকে হত্যার দায়ভারও কি কম? প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে যারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে তারা কারা? তাদের শনাক্ত করে জাতির সামনে উপস্থাপন করা হোক কারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চেয়েছে তাদের গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা হোক আমি বলেছি, যে কোনো ধর্ম-ধর্মবিশ্বাস-ধর্মগ্রন্থ-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর আঘাত করা বা অবমাননা করার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হোক দেশের জাতীয় মসজিদের সামনে কোরআন শরিফে আগুন লাগবে কিংবা কোথাও কোনোভাবে ধরনের ঘটনা ঘটবে, তা কোনো মুসলমান মেনে নিতে পারে না আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম, যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখে শুনেছিলাম যে 'যারা কোরআনে আগুন দিয়েছে তাদের কাউকে ছাড়া হবে না ভিডিও ফুটেজ দেখে একটা একটা করে ধরা হবে' কিন্তু কই? এক মাস গত হয়ে গেল ভিডিও ফুটেজ দেখে তো আজ পর্যন্ত একজনকেও গ্রেফতার করতে দেখলাম না

কোরআন শরিফ পোড়ানোর এত বড় ঘটনা, যা বিশ্বে আর কখনো কোথাও ঘটেছে বলে মনে হয় না এত কোরআন একসঙ্গে পুড়ল তার ভিডিও ফুটেজ প্রধানমন্ত্রী দেখেছেন কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েও প্রশ্ন, এতদিনে কেন কাউকে ধরা হলো না?


মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি বক্তব্য শুনে দারুণভাবে বিস্মিত হতবাক হয়েছি তিনি বলেছেন 'এরশাদ সাহেব তার ক্যাডার বাহিনী দিয়েও কোরআন পুড়িয়েছেন' মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে বলতে চাই, কোরআন পোড়ানোর কথা আমার কানে যাওয়াও পাপ মনে হয় দেশের একজন প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে যা বের হয় তা কোনো সাধারণ কথা নয় তা আইনের সমতুল্য সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর যে কোনো বক্তব্য মর্যাদাপূর্ণ হবে সেটাই বাঞ্ছনীয় আমি কখনো কোনো ক্যাডার গড়ার রাজনীতি করি না আমার দলের কর্মীরা রাজপথে পিস্তল-বন্দুক নিয়ে যুদ্ধে নামে না যদি তা কখনো দেখি তাদের জায়গা আমার দলে হবে না মে আমার দলের কর্মীদের ওপর নির্দেশ ছিল নির্দিষ্ট স্থানে হেফাজতের তৃষ্ণার্ত কর্মীদের পানি পান করানোর কিন্তু ওই দিনে কয়েকজন কর্মী একটা মিছিল করেছে, এমন কিছু ছবি পত্রিকায় প্রকাশের পর তাদের শোকজ করেছি ওইদিন পিস্তল নিয়ে গুলি করার ছবিও টিভি চ্যানেলে দেখা গেছে এবং পত্রিকায় হামেশা ধরনের ছবি ছাপা হতে দেখি কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা আমরা জানি না বা দেখি না প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমার ক্যাডাররা নাকি কোরআন পুড়িয়েছে আমার অনুরোধ, তাদের চিহ্নিত করা হোক আমি তাদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নিয়ে আইনের হাতে সোপর্দ করব ওইদিন যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তাদের সবাইকে গ্রেফতার করা হোক সেখানে যদি আমার দলের কোনো কর্মী থাকে তাহলে তাকে ধরেও শাস্তি দেওয়া হোক কোরআন পোড়ানোর অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হোক, আমি জোর গলায় দাবি জানাই 

উপসংহারে বলতে চাই, হেফাজতে ইসলামের কোনো কর্মী জঙ্গি ছিলেন না ইসলাম নবী (সা.)-এর অবমাননায় তারা আহত হয়ে বিচারপ্রার্থনা করেছিলেন মাত্র একটি মহল তাদের সেই অনুভূতিকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল ফলে তারা হয়েছে পরিস্থিতির শিকার মার খেয়েছেন হেফাজত কর্মীরা, রক্তও দিয়েছেন তারা, আবার বদনামও জুটেছে তাদের ভাগ্যে আলেম-ওলামাদের মনে যে আঘাত লেগেছিল তার কোনো উপশম ছাড়াই তাদের আন্দোলন আপাতদৃষ্টে প্রশমিত হয়েছে তবে এটা হয়তো বাহ্যিক মনের দ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটেনি রাসূলপ্রেমে পাগল এই মানুষগুলো ইসলামের মর্যাদা রক্ষায় যে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলেছিলেন তার রেশ থেকে যাবে অনন্তকাল ধরে যখনই ইসলাম রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মর্যাদার ওপর আঘাত আসবে তখনই ছাইচাপা আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে

সৈজন্যেঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন১৬ই জুন ২০১৩