দিল্লির সুলতানের কাছে তার প্রধান গোয়েন্দা ও বিশেষ উপদেষ্টা একবার নালিশ করলেন যে, একজন দরবেশ কখনোই রাজকীয় দাওয়াতে প্রাসাদে আসেন না। কোন উৎসব অনুষ্ঠানেই তাকে হাজির করা যায় না। শাহী দরবারের মন্ত্রিসভা সভাসদের কাউকে নিজে দাঁড়িয়ে সম্মান তো জানানই না, এদের কেউ তাকে সালাম দিলে এর জবাব পর্যন্ত দেন না, তিনি নিজের খানকায় একাকী ইবাদতে কাটান, উৎসাহী লোকজন সেখানেই ছুটে যায়। মসজিদে গেলেও তিনি খুব নির্জনতা তালাশ করেন এবং দর্শনার্থীদের থেকে পালিয়ে বেড়ান। লোকটিকে খুব অহংকারী মনে হয়, নতুবা সালতানাতের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছেন। তার বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। একথা শুনে সুলতান বললেন, তার বিষয়ে আপনাদের আর কোন কাজ নেই। আমি নিজেই এর খোঁজখবর নেব।
যথারীতি সুলতান একদিন ছদ্মবেশে দরবেশের খানকায় গেলেন। দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করে যখন ভিড় কমে গেল তখন তার খুব কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন, কেন তিনি শাহী দাওয়াতে যান না। জনসমাগমস্থলে গমন করেন না। মসজিদে গিয়েও সবাইকে এড়িয়ে চলেন। সালাম দেয়া-নেয়ার ব্যাপারেও তার একধরনের অনীহাভাব। বিশেষ করে সুলতানের দরবারে তাকে কিছুতেই নেয়া যায় না। এসব প্রশ্ন শুনে দরবেশ তার হাতে ধরে বললেন, দিল্লির বাদশাহ শোন, এসবের উত্তর এক কথায় দেয়া যাবে না। আগামী শুক্রবার সকল মন্ত্রী, সভাসদ নিয়ে এখানে নামাজ পড়। সবাইকে এখানে আসার নির্দেশ দিয়ে, নিজে ছদ্মবেশেই আমার পাশে থেকো।
ছদ্মবেশ ধরা সত্ত্বেও দরবেশ বাদশাহকে চিনে ফেলেছেন বলে বাদশাহ কিছুটা ঘাবড়ে যান। শুক্রবার জুমার পর দরবেশ মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে বাদশাহকে বললেন, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে সব মন্ত্রী, সভাসদ, কর্মকর্তা ও বিশিষ্টজনদের নামাজ শেষে ফিরে যাওয়া দেখে এরপর আমার খানকায় আসবে। এ কথা বলে দরবেশ তার টুপিখানা বাদশাহর মাথায় পরিয়ে দিলেন। দরবেশ যেই মসজিদ থেকে বের হয়েছেন, দেখেন বাদশাহ ভয় পেয়ে দৌড়ে মসজিদ প্রাঙ্গণ পেছনে ফেলে পাশের জঙ্গলে গিয়ে গা ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করছেন। দরবেশ তখন তাকে ইশারা করে বললেন, টুপিটি দ্রুত খুলে ফেলতে। টুপি খুলে ফেললেও বেশ কিছুক্ষণ লাগল তার শান্ত ও স্বাভাবিক হতে।
দরবেশ বাদশাহকে বললেন, কী ব্যাপার? দৌড়ে পালাচ্ছিলে কেন?
বাদশাহ জবাব দিলেন, দেখলাম আমার সামনে হিংস্র সব জন্তু। বড় বড় অজগর, বাঘ, ভল্লুক, সিংহ ও গন্ডার।
দরবেশ বললেন, এরাই তোমার মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সভাসদ ও কর্মকর্তা। আর শোন, যে টুপিটি পরে তুমি তাদের ভেতরের রূপ দেখতে পেলে এবং ভয়ে দৌড়ে গিয়ে জঙ্গলে পালালে, এ টুপিটিই আমাকে রাত-দিন মাথায় পরে থাকতে হয়। তাহলে বল, আমার কতটা ভয় লাগে? কী পরিমাণ সাহস ও ধৈর্য নিয়ে আমি এ সমাজে বাস করি। তা ছাড়া কেন আমি বেশি ঘুরে বেড়াই না, রাজ দরবারে যাই না, সমাবেশে গেলেও নির্জনতা খুঁজে বেড়াই, সালাম দেয়া-নেয়া করতেও ভয় পাই, তা কি তোমায় এখনো বুঝিয়ে বলতে হবে?
বাদশাহ দরবেশের পায়ে পড়ে গেলেন আর বললেন আমার বাহ্যিক রাজত্ব এখন ব্যর্থ। আমার চারপাশে তো শয়তানের রাজত্ব চলছে। আপনি কোরআন-সুন্নাহের আলোয় আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবলে এ সাম্রাজ্যে মনুষ্যত্ব ফিরিয়ে আনুন। মানুষ তার বাহ্যিক রূপের মতোই ভেতর থেকেও মানুষ হোক। এসব সাপ, বিচ্ছু, কুকুর, শৃগাল, বাঘ, সিংহ, আর কুমির চরিত্রের লোকজন নিয়ে সমাজ চলবে কী করে?
দরবেশ বাদশাহকে সান্তনা দিলেন। তার দোয়া ও পরামর্শ নিয়ে সাম্রাজ্য পরিচালনার মাধ্যমে পরিস্থিতি পরিবর্তনের আশা দিয়ে তাকে প্রাসাদে ফিরে যেতে বললেন।
দিল্লির কুতুব মিনার যে দরবেশের নামে সুলতান কুতুবুদ্দীন আইবেক তৈরি করেন তিনিই আলোচ্য দরবেশ হজরত কুতবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রহ.)। তিনি ছিলেন দিল্লির সুলতানের পীর-মুরশিদ ও আধ্যাত্মিক দিশারি। মানবতার উন্নয়নে ও আধ্যাত্মিক বিপ্লব সাধনে বিশ্বসভ্যতায় এরাই সফলতম ব্যক্তিত্ব। আজকের পৃথিবী যদি মুক্তি ও শান্তি চায় তাহলে এদের পথই তাকে লক্ষ্যে নিয়ে যাবে।
আধুনিক যুগেও দায়িত্বশীলদের কোন দিব্য দৃষ্টিবান দরবেশের কাশ্ফ ও কারামাতের সাহায্য নিয়ে নিজের চারপাশ ভালো করে দেখে নেয়া উচিত। তাদের আশপাশে কতজন মানুষ আছেন, আর কী পরিমাণ রয়েছে মানবরূপী হিংস্র জানোয়ার।
যুগে যুগে মানবসমাজকে আত্মশুদ্ধি, ধর্মীয় অনুশাসন, মানবিক প্রেরণা, প্রেমময় মোটিভেশন, আইনের শাসন ও সামাজিক মূল্যবোধে অভ্যস্ত করে এ পর্যায়ে নিয়ে আসার পথে জীবনপাত করেছেন লাখো পীর-আউলিয়া-লোকশিক্ষক। শাসক ও বিচারকদের শিষ্টের পালন আর দুষ্টের দমননীতি সভ্যতাকে এ পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু সুশাসন ন্যায়বিচার ও নৈতিকতার অভাব সমাজকে আবার পিছিয়ে দিতে পারে। দায়িত্বশীলদের গাফিলতি মানুষকে করতে পারে অমানুষ। সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে নেতৃত্বের অপরিনামদর্শী আচরণে।
বিশ্বব্যাপী দায়িত্বশীলদের জন্য এ বার্তাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন,
তোমরা আমার অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে, আল্লাহ তোমাদের অন্তরকে জুড়ে দিয়েছেন, আল্লাহর রহমতে তোমরা ভাইভাই হয়ে গিয়েছ। তোমরা দাঁড়িয়ে ছিলে পতনোন্মুখ তীরে, যা তোমাদের নিয়ে ধসে পড়ছিল জাহান্নামের আগুনে। হঠাৎ করেই আল্লাহ তোমাদের এ অবস্থা থেকে রক্ষা করলেন।
-সূরা আলে-ইমরান ১০৩,
সভ্যতার ধ্বংস যখন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তখন মহানবী (সা.)কে প্রেরণের মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহ মানবসভ্যতাকে নতুন জীবন দিলেন। শত শত বছরের দীক্ষা, সুশাসন ও ন্যায় বিচারের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা মানবসভ্যতা বর্তমানে নীতিহীনতার চর্চার ফলে আবারো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এ থেকে নিষ্কৃতির উপায় আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে।দুঃশাসন, হতাশা, বঞ্চনা, বিচারহীনতা, দুর্নীতি, পাপাচার ও বিশ্বাসভঙ্গ থেকে জন্ম নেয় সামাজিক অস্থিরতা। মানুষ ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, দয়া-মায়া, ক্ষমা, ভালোবাসা, মানবিকতা ভুলে গিয়ে হয়ে ওঠে শয়তানের মতো খারাপ। পশুরাও তখন লজ্জা পায় এসব মানুষকে। এদের পশুর মতো বললে পশুরাও এতে লজ্জা পায়। কেননা, পশুরা হিংস্র ও নির্দয় হলেও এর একটি সীমা আছে। কিন্তু মানুষ যখন খারাপ হয় তখন সে অল্পেই পশুকে ছাড়িয়ে যায়। তখন তার উপর চলে শয়তানের রাজত্ব। শয়তান তাকে দিয়ে এমন সব নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা ও বেহায়াপনা করাতে পারে যা পশুদের দ্বারা সম্ভব নয়।
আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস, আল্লাহর আজাবের ভয়, পরকালে কঠিন শাস্তির ভয়, আইন-বিচার ও সামাজিক প্রতিকারের ভয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিবিধানের ভয় মানুষকে শয়তান হওয়া থেকে ফিরিয়ে রাখে। এর আগে প্রয়োজন সুশিক্ষা, সুস্থ সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় পরিচর্যা, ইতিবাচক সামাজিক আন্দোলন।
বর্তমান বিশ্বে ধর্মকেই সবার আগে আঘাত করা হচ্ছে। ধর্মহীনতাকে বানানো হচ্ছে মানুষের প্রধান নীতি। আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি অবিশ্বাস গড়ে তোলার হাজারো চেষ্টা চলছে। মানবতার মুক্তিদূত প্রিয়নবী (সা.)কে করা হচ্ছে লাঞ্ছনা ও অবমাননার টার্গেট। নির্বিচারে যৌন উত্তেজনাপূর্ণ বিষয়ের চর্চা প্রতিটি মানুষের জন্য সহজলভ্য করে দেয়া হচ্ছে। যাকে অশ্লীলতার অনুশীলন ও প্রচারের মতো মারাত্মক পাপের ভয়াল ব্যাপ্তি বলাই ভালো। পবিত্র কোরআনে যাকে দুনিয়া ও আখিরাতের কঠিনতম দুঃখের কারণরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
চলছে বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, নারী-শিশু ও অসহায় মানুষের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। মিথ্যা, শঠতা, নির্যাতন, নিপীড়ন, লুটপাট, শোষণ ও অন্যায়ের এমন নিশ্চিন্ত মহোৎসব অতীত পৃথিবীতে ছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না।
পাপ ও অন্যায়, প্রাণ, প্রকৃতি ও জলবায়ুর উপরও তার মন্দ প্রভাব ফেলে। হাদিস শরিফে হজরত মহানবী (সা.) বলেছেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তা’আলাও ঘোষণা করেছেন, জল-স্থল ও অন্তরীক্ষে প্রকাশিত নানা বিপর্যয় তোমাদেরই হাতের উপার্জন। মিথ্যাচার, ওজনে কমবেশি, প্রতারণা, অশ্লীলতা, জুলুম, নির্যাতন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পাপাচার সমাজে নানা ধরনের বিকৃতি ধ্বংস ও সর্বনাশ ডেকে আনে যা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া শেষ হয় না।
পরিবারে যিনি প্রধান, সমাজে যারা দায়িত্বশীল, সরকারে যারা কর্তৃত্বশীল, রাষ্ট্রে যারা জিম্মাদার তাদের প্রত্যেককে নিজ অবস্থান সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। কেননা, মহান স্রষ্টা তার গোটা জগত পরিচালনার জন্য যাকে যেখানে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন, একদিন তাকে অবশ্যই সে দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। যদি দায়িত্বশীল ব্যক্তি আল্লাহর দেয়া শিক্ষা, বিবেচনা, বোধ ও আদর্শ কাজে লাগিয়ে সঠিক ভূমিকা রাখেন তাহলে তিনি নিষ্কৃতি পাবেন। আর যদি তার মন মগজ ও নীতিতে শয়তান রাজত্ব করে, যদি তিনি শয়তানের ইশারায় যাচ্ছেতাই করেন তাহলে তার ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার। আল্লাহর বিচারে তিনি অবশ্যই ধরা পড়বেন। অন্যায়, অবিচার, নিষ্ঠুরতা, পাশবিকতা, অশ্লীলতা ও পাপাচার রোধ করা না হলে একটি সভ্যতাও বিলুপ্ত হয়ে যায়, একটি দেশ জাতি ও সমাজ হয়ে ওঠে মনুষ্য বাসের অনুপযোগী।
নেতৃবর্গ, শাসক, সমাজপতিদের এ বোধশক্তিটি লাভ করতে হলে শয়তানের শক্তি থেকে পানাহ চেয়ে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করার বিকল্প নেই। ন্যায়নীতি, সুবিচার ও উত্তমশাসন ছাড়া কোন সমাজ উন্নতি করতে পারে না। বাংলাদেশের সমাজ যত দ্রুত নীতিনিষ্ঠ হবে ততই মঙ্গল, নয়তো এর শেষ শৃঙ্খলাটুকুও ধরে রাখা সম্ভব হবে কি না জানা নেই।